দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন প্রয়োজন
জাতীয় আয়কর দিবসের ভাবনা
চিন্তা থেকে যেমন কাজের উৎপত্তি, আইনের প্রয়োগ তেমনি আইনের দৃষ্টিভঙ্গিভেদে বিভিন্ন রূপ পরিগ্রহ করে। আইনের ভাষা ও মেজাজ এবং প্রক্ষেপণ ও দর্শনের উদ্দেশ্য-বিধেয় বিধৃত হয়ে থাকে। আইনপ্রণেতার মনোভাব, দূরদৃষ্টি, আচার-আচরণ, সংস্কৃতি, স্বভাব-চরিত্র এবং আশা-প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটে আইনের ভাষায়। যারা আইন তৈরি করেন, তাদের সঙ্গে; যাদের জন্য আইনটি তৈরি করা হয় অর্থাৎ যাদের ওপর এটির প্রয়োগ হবে, তাদের মধ্যকার সম্পর্কেরও একটি বিশেষ ভূমিকা আছে আইনের দৃষ্টিভঙ্গি নির্মাণে। এখানে তৃতীয় আরেক শরিকের কথাও এসে যায়। যাদের মাধ্যমে আইনটির প্রয়োগ হবে, তাদের সক্ষমতা-অক্ষমতার ব্যাপারটিও বিশেষভাবে বিবেচ্য থেকে যায় আইনের প্রয়োগ তথা বাস্তবায়নযোগ্যতার ক্ষেত্রে। আইন পরিষদ যে আইন তৈরি করে, এর প্রয়োগ হয় যারা আইন তৈরির ক্ষমতা দিয়েছেন, তাদের ওপর। আর এই আইন প্রয়োগের দায়িত্বও আইনপ্রণেতার নয়, নির্বাহী বিভাগের। এখন পরিবেশ পরিস্থিতি যদি এমন হয় বা আইন পরিষদ যদি মনে করে এ আইন অন্যের জন্য, পরিষদ সদস্যদের ওপর বর্তাবে না এবং নির্বাহী বিভাগও যদি ভাবে, এ আইন অন্যের ওপর প্রয়োগের জন্যই তা হলে যাদের ওপর আইনের প্রয়োগ, তারা হয়ে পড়েন বিচ্ছিন্ন দ্বীপ; প্রয়োগের প্রতিক্রিয়া প্রকাশের ক্ষেত্রেও তারা যেন হয়ে পড়েন প্রতিপক্ষ আইনপ্রণেতা ও প্রয়োগকারীর। এ প্রতিপক্ষতার পরিবেশেই আইনের দৃষ্টিভঙ্গি হয়ে যায় নিবর্তনমূলক, প্রতিরোধাত্মক। এই প্রেক্ষাপটে আইন অমান্য ও অগ্রাহ্যের পরিবেশ সৃষ্টি হয়।
আইন মানুষের জন্য, মানুষ আইনের জন্য নয় কিংবা মানুষের জন্য আইন, আইনের জন্য মানুষ নয় এ স্বতঃসিদ্ধ ব্যাপারটি বিশ্লেষণে গেলে এটি স্পষ্ট হয়ে প্রতিভাত হয়, মানুষের কল্যাণেই আইনের প্রয়োজন। তবে মানুষ আগে, আইন পরে। আইন মানুষকে মুক্তির জন্য, তাকে বন্দি করার জন্য নয়। মানুষের মৌলিক অধিকার আইনের আওতায় স্বীকৃত, নিশ্চিত, নির্ধারিত, নিবন্ধিত হয়ে থাকে। মানুষ তার চিন্তা, বিশ্বাস, শরীর, দেহ, চলাচল, সম্মান ও মর্যাদার প্রতিষ্ঠা, বিকাশ এবং নিরাপত্তা দাবি করতে পারে আইনের কাছে। তাই যে কোনো আইনের দৃষ্টিভঙ্গিতে সর্বজনীনতা ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে নিরপেক্ষতার একটি অন্যতম মৌলিক বৈশিষ্ট্য হওয়ার আবশ্যকতা অনস্বীকার্য। নিবর্তনমূলক কিংবা প্রতিরোধাত্মক দৃষ্টিভঙ্গিসঞ্জাত আইন কল্যাণপ্রদ আইন হিসেবে বিবেচিত হতে পারে না। যে আইন যত সর্বজনগ্রাহ্য, সর্বজনমান্য, সর্বজনবোধ্য, সর্বজন অনুসৃতব্য ওই আইন তত কল্যাণকর ও কার্যকর।
আইনকে সর্বজনগ্রাহ্য, মান্য, বোধ্য, অনুসরণযোগ্য হতে হলে ওই আইনের ভাষা বা দৃষ্টিভঙ্গিতে সর্বজনীনতা, ন্যয়-নীতিনির্ভরতা ও নিরপেক্ষতার প্রতিফলন থাকা চাই। যাদের জন্য আইনপ্রণয়ন কিংবা যারা করবেন এর প্রয়োগÑ তাদের থেকে আসা উচিত আইনপ্রণয়নের তাগিদ, মাল-মসলা, যুক্তি-তর্কানুমোদিত সুপারিশ বা পরামর্শ। উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া নির্দেশনা নিচে যে আছে, তার পক্ষে পরিপালন যথাসিদ্ধ হয় না। কেন আইনের প্রয়োজন, কতটুকু প্রয়োজন, কার কার জন্য প্রয়োজন, কীভাবে তা প্রয়োগ এসব বিষয়ে ক্ষৈত্রিক পর্যায় থেকেই আসবে উপাত্ত। আইনের উৎস হবে তারাই যাদের জন্য এটি প্রণীত হচ্ছে। এখানে অবরহ অর্থাৎ উপর থেকে নয়; আরোহ অর্থাৎ নিচ থেকেই আসা আবশ্যক ধারণা, যৌক্তিকতা এবং পন্থা-পদ্ধতির প্রবেশক। আইন যে সমাজ বা সময়ে প্রয়োগযোগ্য হবে, ওই সমাজ কিংবা সময়ে এটি ডাইজেস্টবল কিনা এটি দেখাও আবশ্যক হয়ে যায়। বিদ্যমান বা চলমান আইনের সংস্কারের প্রশ্নটি ওই নিরীখেই এসে যায়। অনেক ভালো বা মন্দ আইন সময় ও সমাজের পরিবর্তন প্রেক্ষাপটে সংস্কারের অনিবার্যতায় আপতিত হয়। আইন যুগ-ধর্মবিস্মৃত হয়ে অনড় হতে পারে না। এটিকে যুগোপযোগীকরণ ও সরলীকরণে সংশোধন, সংযোজন, বিয়োজনের জন্য ফ্লেক্সিবল হতে হয়। যে আইন যত সংস্কারযোগ্য, সেটি তত সচল-সজীব ও দীর্ঘজীবী। আইনের ভাষা ও গতি-প্রকৃতিতে এই প্রাগ্রসরমানতার বৈশিষ্ট্য বিশেষ জরুরি।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
উপরের তাত্ত্বিক ধ্যান-ধারণার আলোকে আমরা বাংলাদেশের আয়কর আইনের একটি সুরতহাল রিপোর্ট তৈরিতে মনোনিবেশ করতে পারি। বাংলাদেশের বিদ্যমান আয়কর আইনটি জন্মগতভাবে ব্রিটিশ, দৃষ্টিভঙ্গির বিচারে ঔপনিবেশিক এবং প্রায়োগিক দিক থেকে নিবর্তন ও প্রতিরোধাত্মক। এ দেশে ভূমি কর বা রাজস্ব আদায়, এর প্রথা প্রাগৈতিহাসিক আমল থেকে। রাষ্ট্র্রীয় নিরাপত্তা প্রদান, বিভিন্ন সেবার বিনিময় কিংবা উৎপাদন বা সম্পদ ব্যবহার বাবদ নানা নামে নানা উপায়ে রাজস্ব অথবা টোল বা সেস আদায়ের প্রথা ওই আদি যুগ থেকে চলে এলেও আধুনিক আয়কর বলতে যে বিশেষ কর-রাজস্বের সঙ্গে আমরা পরিচিত এ দেশে তথা ভারতীয় উপমহাদেশে এর প্রবর্তন ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে সাত সাগর তেরো নদীর পার থেকে আসা বিদেশি বেনিয়ার দ্বারা। তাদের তৎকালীন সমাজে শিল্পবিপ্লবের পর পুঁজির প্রসার ঘটে এবং সেখানে সম্পদের ওপর, সম্পদ সৃষ্টি ও বিনিময় প্রক্রিয়ায় অতিরিক্ত আয় অর্জনের সুযোগ সৃষ্টি হয়। রাষ্ট্র ওই অতিরিক্ত আয়ের ওপর একটি হিস্যা দাবি করে বসে। যুক্তি এই যে, তুমি রাষ্ট্রের তৈরি অবকাঠামো ব্যবহার করে আয়-উপার্জন করছ, রাষ্ট্রের সেবা ও সুবিধা ভোগ করে লাভবান হচ্ছ। তাই এসব অবকাঠামো নির্মাণ, সুযোগ-সুবিধার সমাহার বাবদ রাষ্ট্রের বিনিয়োগে তোমার অংশগ্রহণ চাই। ‘নো লাঞ্চ ইজ ফ্রি’ অংশীদারিত্বের দর্শন থেকে ইউরোপে আধুনিক আয়কর ধারণার উৎপত্তি। ‘নেবে আর দেবে, দেবে আর নেবে, এভাবে মিলাবে নিকাশ’Ñ পরস্পরের প্রতি আস্থা ও দায়িত্ববোধের বিকাশ ধ্রুপদ আয়কর ব্যবস্থাপনার প্রভাতসংগীত।
এ দেশে যারা আয়কর আইন আমদানি করেছিলেন, যে সময়ে এনেছিলেন, যাদের জন্য এনেছিলেন এবং যাদের ওপর অর্পিত হয়েছিল এর প্রয়াগ-প্রবর্তনের ভারÑ তাদের প্রত্যেকের নাড়ি-নক্ষত্র পরীক্ষা-পর্যালোচনায় বিদ্যমান আয়কর আইনের চরিত্র ও চারিত্র্য, এর শরীর এবং শারীর শনাক্তকরণ সহজ হতে পারে। আমরা জানি, এ দেশ ১৭৫৭ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্তৃত্বাধীনে চলে যায়। রেজা খান সেতাব রায়দের মাধ্যমে মাসোহারাপ্রাপ্তির পর্ব পেরিয়ে ১৭৯৩ সালে লর্ড কর্নওয়ালিস প্রবর্তিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে কোম্পানি মূলত এবং মুখ্যত লাভজনক ব্যবসায়িক দৃষ্টি ও রীতি-পদ্ধতিতেই চালিয়েছিল শাসনকার্য। কোম্পানির স্বার্থে ও সুবিধার জন্য ১৭৬৫ সালে বাংলার কৃষিপণ্যকে বাণিজ্যিকীকরণ, ১৭৭৩ সালে রেগুলেটিং অ্যাক্ট পাস, ১৮১৩ সালে ভারতে ফ্রি ট্রেড প্রবর্তন এবং ওই বছরই বাংলার মুখ্য শিল্প খাত টেক্সটাইল এক্সপোর্ট বন্ধ, ১৮২০ সালে টেক্সটাইলকে ইম্পোর্ট পণ্য হিসেবে ঘোষণা, ১৮৩০ সালে কলকাতা ডকিং কোম্পানি প্রতিষ্ঠা, ১৮৩৫ সালে ইংরেজিকে অফিস-আদালতের ভাষা হিসেবে ঘোষণা, ১৮৩৮ বেঙ্গল বন্ডেড ওয়্যার হাউস অ্যাসোসিয়েশন গঠন এবং ১৮৪০ সালে বেসরকারি খাতে চা বাগান স্থাপনের মাধ্যমে এ দেশীয় অর্থনীতির স্বনির্ভর সত্তাকে পরনির্ভরকরণের কার্যক্রম শুরু হয়। ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের পর এ দেশের শাসনভার কোম্পানির কাছ থেকে ব্রিটিশ সরকারের হাতে ন্যস্ত হয়। ব্রিটিশ শাসনামলেই শাসকের সঙ্গে শাসিতের দায়দায়িত্ব পালনের প্রশ্ন সামনে আসে এবং ইউরোপীয় শিল্পবিপ্লবের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাবে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্যব্যবস্থার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয় এ দেশের অর্থনীতি। এ প্রেক্ষাপটেই উৎপাদন, বিপণন, বাণিজ্যব্যবস্থায় সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে আয়কর আদায়ের যৌক্তিকতা দেখা দেয়। ভারতে ব্রিটিশ সরকারের প্রথম অর্থমন্ত্রী উইলসন আয়কর প্রবর্তন করেন ১৮৬০ সালের বাজেট বক্তব্যে। এর পর প্রথমে ১৮৬২ থেকে ১৮৬৭ সাল পর্যন্ত সীমিত অবয়বে আয়কর আদায়ের আয়োজন চলে। মাঝে বন্ধ হয় কার্যক্রম। আবার ১৮৮০ সালের পর কয়েক বছর পরীক্ষামূলকভাবে চলে। সরকার স্থায়ীভাবে কোনো আইন না করে স্থানীয়ভাবে এসআরও বা সার্কুলার জারি করে আয়কর আদায় কার্যক্রম পরিচালনা করে। তবে এসব সার্কুলার ব্রিটিশ আইনের আদলে ও দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রণীত হলেও এ দেশীয় করদাতাদের প্রতি তাদের বশংবদ অদায়িত্বশীল আচরণ, পারস্পরিক অবিশ্বাস, ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতা, প্রতিরোধমূলক দৃষ্টিভঙ্গি ওই সার্কুলারের বাকপ্রতিমায় প্রাধান্য পায়।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ : সাবেক সচিব ও এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান
আরও পড়ুন:
দিকে দিকে মাফিয়াতন্ত্র-২