সময় নষ্ট হয়েছে, তবে সুযোগ ফুরিয়ে যায়নি

জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা

আনালিনা বেয়ারবক
৩০ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০
শেয়ার :
সময় নষ্ট হয়েছে, তবে সুযোগ ফুরিয়ে যায়নি

নাইজারের একজন কৃষকের কথা ভাবুন, খরায় চৌচির হয়ে গেছে যার ক্ষেত। পালাউয়ের একজন বাবার কথা চিন্তা করুন, যিনি নিশ্চিত নন যে, তার সন্তানরা বড় হওয়ার পর তার ঘরবাড়ি আদৌ দেখতে পাবে কি না, নাকি সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে তার পুরো গ্রামই তলিয়ে যাবে অথৈ জলে।

স্পেন, জার্মানি বা লিথুয়ানিয়ার মেয়ররা তাদের শহরগুলোকে একদিকে খরার হাত থেকে অন্যদিকে বিপজ্জনক বন্যা থেকে রক্ষা করার উপায় খুঁজে বের করতে মরিয়া।

এভাবে আপনি বিশ্বের যে প্রান্তেই তাকান না কেন, একটি সংকট সর্বত্রই স্পষ্ট : জলবায়ু সংকট।

এই সংকট আমাদের যুগের সবচেয়ে বড় নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ। কম-বেশি আমাদের সবার ওপরেই এই সংকটের প্রভাব পড়েছে। তবে আমি এই কারণে আশাবাদী যে, আমাদের কাছে জ্ঞান ও প্রযুক্তি আছে এবং সেই সাথে জলবায়ু সংকটকে সমবেতভাবে মোকাবিলা করবার কৌশল জানা আছে। আমাদের এখন যা দরকার তা হলো রাজনৈতিক সদিচ্ছা।

২০১৫ সালে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই ইচ্ছা দেখিয়েছিল। প্যারিস চুক্তির মধ্য দিয়ে একটি নতুন, জলবায়ু-নিরপেক্ষ পৃথিবীর জন্য পথ প্রশস্ত হয়েছিল সেবার। তখন প্রায় ১৭০টি দেশ নিজেদের উচ্চাভিলাষী জলবায়ু লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল। বলতেই হবে, নবায়নযোগ্য শক্তির সম্প্রসারণ নাটকীয়ভাবে ত্বরান্বিত হয়েছে।

তবে যখন দুবাইয়ে জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলনের জন্য একত্রিত হচ্ছি, তখন আমরা এও বুঝতে পারছি যে, এরই মধ্যে সময় নষ্ট হয়ে গেছে অনেক, এখন সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছুটতে হবে; কারণ এত দিন পর্যন্ত আমরা খুব ধীরগতি ছিলাম।

এবারের জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলন তথা কপ২৮ আমাদের গতি বাড়ানোর এক বিশাল সুযোগ। আমরা এই সুযোগকে কাজে লাগাতে পারি। যেমন, জলবায়ু পদক্ষেপে এগিয়ে থাকা দেশগুলোর মধ্যে জোট গঠন করতে পারি।

প্যারিসে সম্মত গ্লোবাল স্টকটেক পরিকল্পনা নিয়ে আমরা প্রথমবারের মতো কার্যকরী রূপরেখা তৈরি করব দুবাইয়ে। প্যারিস সম্মেলনে নির্ধারিত লক্ষ্যে পৌঁছানোর দিকে আমাদের অগ্রগতি পর্যালোচনা করতে এবং কোথায় আমাদের পদক্ষেপ নিতে হবে তা নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে এই রূপরেখা সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।

জার্মানি বিশ্বাস করে, এ ক্ষেত্রে তিনটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

প্রথমত, ২০৩০ সালের মধ্যেই নবায়নযোগ্য শক্তির বৈশ্বিক উৎপাদন ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করতে হবে। এক টন কার্বন ডাইঅক্সাইড নিঃসরণের মধ্য দিয়ে একটি দেশ আমাদের সবার ক্ষতি করে থাকে। জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক পরিষদ বলছে, এই দশকে বৈশ্বিক নির্গমন কমপক্ষে ৪৩ শতাংশ হ্রাস করতে হবে, সেজন্য আমাদের একতাবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। আমরা যত বেশি হারে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমাতে পারব, তত কম খরা হবে, কম বন্যা হবে এবং কম প্রাণ ঝরবে।

দ্বিতীয়ত, জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় আমাদের সর্বোত্তম হাতিয়ার হলো সংহতি। এ কারণেই আমরা তাদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়িয়ে আছি, জলবায়ু সংকট সৃষ্টিতে যাদের দায় সবচেয়ে কম অথচ তারাই এখন সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

এই কারণেই, তৃতীয়ত, জার্মানি কপ২৮-এ অংশীদারত্ব বাড়াতে চায়। নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদন ও জলবায়ু পদক্ষেপের জন্য প্রয়োজনীয় শর্তগুলো যে একেক দেশে একেক হবে, আমরা তা বুঝি। এবং আমরা এও মনে করি, শক্তির সবুজ রূপান্তর যে আমূল পরিবর্তন আনবে তা কেবল সামাজিকভাবে ন্যায়সঙ্গত হলেই সফল হতে পারে। আমরা এই লক্ষ্যেই আমাদের অংশীদারদের সমর্থন করব।

সৌর প্যানেল, সবুজ হাইড্রোজেন বা তাপ নিরোধক প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ করা মানেই প্রবৃদ্ধি, নতুন কর্মসংস্থান ও নিরাপদ শক্তি সরবরাহের সুযোগ। এতে আমরা সবাই উপকৃত হব। ঠিক এ জন্যই আমরা জলবায়ু, জ্বালানি ও উন্নয়ন অংশীদারত্ব বাড়াচ্ছি। আরেকটা কথা, উন্নয়ন করব নাকি জলবায়ু পদক্ষেপ নেব, এমন দোটানায় কোনো দেশেরই থাকা উচিত নয়। প্রত্যেক দেশ, প্রতিটি সমাজ অবশ্যই নিজস্ব পরিকল্পনামাফিক এগোবে।

তবে গুরুত্ববহ কথা এই যে, আমাদের সবার লক্ষ্য এক : একটি জলবায়ুনিরপেক্ষ ও প্রাণোচ্ছল পৃথিবী যেখানে আমাদের শিশুদের জন্য সমৃদ্ধি ও নিরাপত্তা উভয় থাকবে। একসাথে এই যাত্রা আরম্ভের সুযোগ হোক দুবাই সম্মেলন।

আমাদের এই সুযোগটা কাজে লাগাতেই হবে।


আনালিনা বেয়ারবক : জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী

ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন আমাদের সময়ের সহকারী সম্পাদক জাহাঙ্গীর সুর