ব্যাংকে খেলাপি ঋণের সুনামি ছাড়াল ছয় লাখ কোটি টাকা
দিন যত যাচ্ছে ততই ভয়াবহ আকার ধারণ করছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ। গত জুন শেষে দেশের ব্যাংক খাতে প্রথমবার খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছয় লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় পৌনে ২ লাখ কোটি টাকা। এক বছরের ব্যবধানে বেড়েছে তিনগুণেরও বেশি। খেলাপির হার উঠেছে প্রায় ৩৫ শতাংশ। সবচেয়ে উদ্বেগজনক অবস্থায় পৌঁছেছে শরিয়াভিত্তিক ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ। এসব ব্যাংকের প্রতি ১০০ টাকা ঋণের মধ্যে ৫৫ টাকাই এখন খেলাপি। প্রায় একই অবস্থা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর, তাদের খেলাপির হার প্রায় ৪৪ শতাংশ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ‘ব্যাংকি খাত আপডেট’ শীর্ষক এক পর্যালোচনা প্রতিবেদনে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খেলাপি ঋণ যে হারে বাড়ছে, এটি শুধু ব্যাংক খাতে নয়- সার্বিক অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এর ফলে ব্যাংকগুলো ঋণ দিতে অস্বস্তিতে পড়ছে। এতে নতুন বিনিয়োগ ও শিল্প-কারখানার সম্প্রসারণ থেমে গিয়ে কর্মসংস্থানও হুমকির মুখে পড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে খেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণসহ ঋণ আদায়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের ওপর জোর দেন তারা।
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ব্যাংক খাতে লুকানো খেলাপি ঋণ সামনে আসছে। পাশাপাশি সরকার পরিবর্তনের পর খেলাপি ঋণ কাগজে-কলমে কম দেখানোর নীতি থেকেও সরে আসে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে অস্বাভাবিক গতিতে বাড়ছে খেলাপি ঋণ, যা নিয়ে সর্বমহলে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে। খেলাপিঋণের বৃদ্ধি নিয়ে চিহ্নিত খোদ কেন্দ্রীয় ব্যাংকও। এ কারণে আলোচ্য জুন প্রান্তিকের খেলাপি ঋণের তথ্য প্রকাশ করা থেকে বিরত রয়েছে। এর মধ্যেই খেলাপি ঋণের (এনপিএল) লাগামহীন বৃদ্ধি নিয়ে গত সপ্তাহে উদ্বেগ প্রকাশ করে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। সেই সঙ্গে খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনতে কার্যকর পদক্ষেপের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংককে জোর তাগিদ দেয় সংস্থাটি। গত সপ্তাহে দেশের ৪৭টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠক করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, যেখানে প্রতিটি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ আদায় পরিস্থিতি, পুনঃতফসিল ও অবলোপন পরিকল্পনা জানতে চাওয়া হয়েছে। মূলত ব্যাংক ও আর্থিক খাতে স্থিতিশীলতার স্বার্থে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনতে চাইছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
আরও পড়ুন:
একে আবদুল মোমেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী
সূত্র জানায়, কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রতি তিন মাস পরপর খেলাপি ঋণের একটি প্রতিবেদন তৈরি করে নিয়মিত প্রকাশ করে। প্রতি প্রান্তিক শেষ হওয়ার পর সাধারণত দেড় থেকে দুই মাসের মধ্যে তা প্রকাশ করা হয়। তবে আলোচ্য প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ মাত্রাতিরিক্ত হারে বৃদ্ধির কারণে তা প্রকাশে সময়ক্ষেপণ করা হচ্ছিল। মূলত গত কয়েক প্রান্তিকে খেলাপি ঋণের চিত্র যেভাবে বাড়ছে, তাতে দেশের ঋণমাণ কমে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যবসা-বাণিজ্যের খরচ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থেকে তা প্রকাশ করেনি। তবে ‘ব্যাংকিং খাত আপডেট’ শীর্ষক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নতুন একটি পর্যালোচনা প্রতিবেদনে খেলাপি ঋণের সর্বশেষ তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত বছরের জুনে ব্যাংক খাতে মোট বিতরণ করা ঋণের স্থিতি ছিল প্রায় ১৫ লাখ ৯৭ হাজার ১০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ৯৪ হাজার কোটি ৮৪৬ টাকা, যা মোট ঋণের ১২ দশমিক ১২ শতাংশ। গত জুন শেষে ব্যাংক খাতে মোট বিতরণ করা ঋণের স্থিতি বেড়ে হয়েছে প্রায় ১৭ লাখ ৩৪ হাজার ২০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়ে পড়েছে প্রায় ছয় লাখ ৩৩ কোটি টাকা। এটি ব্যাংক খাতে মোট বিতরণ করা ঋণের ৩৪ দশমিক ৬০ শতাংশ। অর্থাৎ রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের এক বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ৪ লাখ ৫ হাজার ১৮৭ কোটি টাকা। অন্যদিকে গত মার্চ পর্যন্ত খেলাপি ঋণ ছিল ৪ লাখ ২১ হাজার ২৯৯ কোটি টাকা বা ২৪ দশমিক ৬০ শতাংশ ছিল। ফলে তিন মাসের ব্যবধানে খেলাপিঋণ বেড়েছে প্রায় ১ লাখ ৭৮ হাজার ৭৩৩ কোটি টাকা।
ইসলামী ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের হার সর্বোচ্চ: প্রতিবেদনে দেখা যায়, শরিয়াভিত্তিক ১০টি ব্যাংকে খেলাপি ঋণের হার ৫৫ শতাংশ ছাড়িয়েছে, যার ৬টিই ছিল বিতর্কিত এস আলমের দখলে। টাকার অঙ্কে এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৫৯ হাজার ৮০ কোটি টাকা। তবে সার্বিকভাবে বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণ (শরিয়া ব্যাংকসহ) ৪ লাখ ২৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা বা ৩২ দশমিক ৯ শতাংশ। খেলাপি ঋণের হারে দ্বিতীয় অবস্থানে রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় ব্যাংক। তাদের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৫২ হাজার ৭৫৫ কোটি টাকা বা ৪৪ দশমিক ৬ শতাংশ। বিশেষায়িত দুই ব্যাংকে খেলাপি ঋণ ১৯ হাজার ৩০৫ কোটি টাকা বা ৩৯ শতাংশ। আর বিদেশি নয় ব্যাংকের খেলাপি ঋণ মাত্র ২ হাজার ৯৫২ কোটি টাকা ৬ দশমিক ১০ শতাংশ।
ব্যাংকের যাত্রাভিত্তিক খেলাপি ঋণের হার: কোন প্রজন্মের ব্যাংকে খেলাপি ঋণের হার কেমন সেটিও প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, খেলাপি ঋণের দিক থেকে সবচেয়ে উদ্বেগজনক অবস্থায় রয়েছে চতুর্থ প্রজন্মের ব্যাংকগুলো (যাত্রা ২০১৩ সালে)। তাদের খেলাপি ঋণের হার ৫৩ শতাংশ ছাড়িয়েছে। প্রথম প্রজন্মের পুরনো ব্যাংকগুলোরও ( যাত্রা ১৯৭২ থেকে ১৯৮৭ এর মধে) খেলাপি ঋণ পরিস্থিতি ভালো নয়। তাদের খেলাপি ঋণ ৪০ শতাংশ ছাড়িয়েছে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রজন্মের ব্যাংকগুলোরও (যাত্রা ১৯৯২ থেকে ১৯৯৮ এবং ১৯৯৯ থেকে ২০০১) খেলাপি ঋণও বেড়েছে। এর মধ্যে দ্বিতীয় প্রজন্মের ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ১৯ দশমিক ৩০ শতাংশ এবং তৃতীয় প্রজন্মের ব্যাংকের ২৭ দশমিক ৬ শতাংশ। তবে পঞ্চম প্রজন্ম তথা নতুন ব্যাংকগুলো (যাত্রা ২০১৬ থেকে ২০২১) খেলাপি ঋণের দিক থেকে এখন পর্যন্ত তুলনামূলক ভালো অবস্থানে রয়েছে, তাদের খেলাপি ঋণ মাত্র ৬ শতাংশ। অন্যদিকে বিদেশি ব্যাংকগুলো ব্যতিক্রম। তাদের খেলাপি ঋণ মাত্র ৬ শতাংশের কাছাকাছি, যা তাদের কঠোর ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ও গ্রাহক বাছাইয়ে সতর্কতার প্রমাণ।
আরও পড়ুন:
পাল্টে যেতে পারে আন্দোলনের ধরন
লুকানো খেলাপি ঋণ বের করার পর কমানোর উদ্যোগ: গত কয়েক প্রান্তিকে লুকানো খেলাপি ঋণ বের হয়ে আসায় নতুন করে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা তৈরি হয়। এর প্রেক্ষিতে এখন ছাড় দিয়ে হলেও তা কমানোর চেষ্টা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত ১৬ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংক মাত্র ২ শতাংশ ডাউনপেমেন্টে ১০ বছরের জন্য ঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগ দিয়ে সার্কুলার জারি করে। এর আওতায় আগামী ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত আবেদনের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এর আগে চলতি বছরের ৩১ জানুয়ারি ব্যবসায়ীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ পুনর্গঠনে নীতি সহায়তা কমিটি গঠন করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই কমিটির আওতায় চার শতাধিক প্রতিষ্ঠান পুনঃতফসিল সুবিধা পায়। অন্যদিকে খেলাপি ঋণ কমাতে ঋণ অবলোপনের শর্ত দুই দফা শিথিল করে বাংলাদেশ ব্যাংক। আগে যেসব ঋণ টানা দুই বছর মন্দ ও ক্ষতিজনক মানে শ্রেণিকৃত থাকে, কেবল সেসব ঋণই অবলোপন করা যেত। সেটি শিথিল করে সংশ্লিষ্ট গ্রাহককে ৩০ দিনের নোটিশ দিয়েই অবলোপনের সুযোগ দেওয়া হয়। আর গত সপ্তাহে সেটি আরও শিথিল করে সংশ্লিষ্ট গ্রাহককে ১০ কর্মদিবস আগে নোটিশ প্রদানের মাধ্যমে অবলোপনের সুযোগ দেওয়া হয়েছে।