ভবিষ্যতের খাদ্যব্যবস্থা গড়ার বৈশ্বিক অঙ্গীকার

আরিফুজ্জামান মামুন, বেলেম (ব্রাজিল) থেকে
২০ নভেম্বর ২০২৫, ০৮:২৬
শেয়ার :
ভবিষ্যতের খাদ্যব্যবস্থা গড়ার বৈশ্বিক অঙ্গীকার

জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে যখন কৃষি, খাদ্যব্যবস্থা ও গ্রামীণ জীবিকা চরম ঝুঁকিতে, তখন ব্রাজিলের বেলেমে চলমান কপ-৩০ গতকালের পুরো দিনটাই উৎসর্গ করা হয় কৃষি, খাদ্য নিরাপত্তা, নারীর নেতৃত্ব, পরিবারভিত্তিক কৃষি, আফ্রো-বংশোদ্ভূত জনগোষ্ঠীর অধিকার ও টেকসই পর্যটনের মতো বিষয়গুলোকে। দিনটির মূল বার্তা ছিল ভূমি পুনরুদ্ধার, নারীর ক্ষমতায়ন এবং বিজ্ঞানভিত্তিক সমাধানের মাধ্যমে ভবিষ্যতের খাদ্যব্যবস্থা টিকিয়ে রাখা।

ব্রাজিলের যে বেলেম শহরকে ঘিরে পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম বন আমাজনের হৃদস্পন্দন, সেই শহর এখন দাঁড়িয়ে আছে বৈশ্বিক জলবায়ু কূটনীতির সর্বাধিক ঘনঘটায় ভরা এক সন্ধিক্ষণে। এর মধ্যে ১৯ নভেম্বর দিনটি ছিল কপ-৩০ এর জন্য বিশেষ তাৎপর্যময়। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে যখন খাদ্যব্যবস্থা বিপর্যস্ত, কৃষিজমির স্থায়িত্ব হুমকির মুখে, আর নারী ও স্থানীয় জনগোষ্ঠী বহন করছে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকি; তখন বেলেম সকালের আলোয় মুখর হয়ে ওঠে খাদ্য নিরাপত্তা, ভূমি পুনরুদ্ধার, লিঙ্গসমতা ও কৃষিভিত্তিক জীবিকা নিয়ে উচ্চপর্যায়ের ধারাবাহিক বৈঠকে। তারপরও কপ-৩০ এর আলোচনায় আছে উদ্বেগ। দর কষাকষিতে এখনও উল্লেখযোগ্য সাফল্য দেখা যায়নি। তবে আশা হারাচ্ছে না কেউই। পৃথিবী টিকিয়ে রাখতে হলে যে সমাধান বের করতে হবেই- এই চাপই আলোচনার ঘরগুলোকে উত্তপ্ত করে রেখেছে।

গতকাল সকালের প্রথম উচ্চপর্যায়ের আলোচনায় ‘উইমেন ভয়েজ দ্যাট গাইড দি ফিউচার’ অনুষ্ঠানে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের নারী নেতৃত্ব তাঁদের অভিজ্ঞতা উপস্থাপন করেন। আফ্রিকা, এশিয়া, লাতিন আমেরিকার গ্রামীণ অঞ্চলে বসবাসকারী নারীরা, যাঁদের ওপর জলবায়ুর অভিঘাত সবচেয়ে বেশি- তাঁরা দেখান কীভাবে প্রতিদিনের চ্যালেঞ্জের মধ্যেও তাঁরা পানির সংকট মোকাবিলা করছেন, লবণাক্ত জমিতে নতুন ফসলের চাষ করছেন, প্রাণিসম্পদের নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করছেন এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জ্ঞানকে আধুনিক বিজ্ঞানের সঙ্গে মিলিয়ে নতুন সমাধান তৈরি করছেন। তাঁদের অভিজ্ঞতা তুলে ধরার মধ্য দিয়ে আলোচনায় নারীর নেতৃত্বকে জলবায়ু নীতির কেন্দ্রীয় স্তম্ভ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।

এই প্রেক্ষাপটে ব্রাজিল আনুষ্ঠানিকভাবে উপস্থাপন করে তাঁদের জাতীয় কর্মকৌশল- প্রটোকল ফর উইমেন অ্যান্ড গার্লস ইন ক্লাইমেট ইর্মাজেন্সিজ’। এই নীতিতে দুর্যোগের সময় নারী ও কন্যাশিশুর নিরাপত্তা, সহায়তা, অংশগ্রহণ এবং নেতৃত্বের জন্য বিশেষ নির্দেশনা ও কাঠামো নির্দিষ্ট করা হয়েছে। জলবায়ু জরুরি পরিস্থিতিতে নারী নেতৃত্বকে প্রতিষ্ঠিত করতে এ প্রটোকলকে একটি মাইলফলক হিসেবে দেখা হচ্ছে। এটি কপ-৩০ অ্যাকশন এজেন্ডা হিসেবে বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে।

এরপর সবচেয়ে আলোচিত ইভেন্ট ‘রাউজ-রিসাইলেন্ট অ্যাগ্রিকালচার ইনভেস্টমেন্ট ফর নেট-জিরো ল্যান্ড ডিগ্রেডেশন’-আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয়। উদ্বোধনী বক্তব্যে বিজ্ঞানীরা জানান, বর্তমানে বিশ্বে প্রতি বছর লাখ লাখ হেক্টর জমি অনাবাদি হয়ে পড়ছে, যা খাদ্যব্যবস্থাকে সবচেয়ে বড় হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। ভূমি অবক্ষয়ের হার যত বাড়ছে, ততই বাড়ছে খাদ্যের দাম, কৃষকের ক্ষতি ও জীবিকা সংকট। এই প্রেক্ষাপটে রাউজের লক্ষ্য হলোÑ টেকসই কৃষি চর্চার বিস্তার, ক্ষতিগ্রস্ত জমি পুনরুদ্ধার, কৃষিজমিতে কার্বন সংরক্ষণ বাড়ানো এবং গ্রামীণ সম্প্রদায়ের জীবিকা পুনর্গঠনে অর্থনৈতিক বিনিয়োগ বৃদ্ধি।

দুপুরের আগে ‘স্কেলিং আপ প্রাকটিক্যাল সলিউশন ফর রিসাইলেন্ট অ্যাগ্রি ফুড সিস্টেম’ শীর্ষক আলোচনায় ঘোষিত হয় একাধিক গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ। সিসিএসি অ্যাগ্রিকালচার ফ্লাগশিপ ২০২৬-২০২৮ সময়কালের জন্য নতুন কর্মপরিকল্পনা প্রকাশ করে এবং সার ব্যবহারে বৈশ্বিক দক্ষতা বাড়ানোর লক্ষ্যে একটি ‘ফার্টিলাইজার কল টু অ্যাকশন’ ঘোষণা করা হয়। পাশাপাশি ২০২৫ সালের সিআরডিএফ বিশ্লেষণ প্রকাশ এবং জার্মান সরকারের ফাস্ট পার্টনারশিপে নতুন ইম্প্যাক্ট সহায়তা কৃষির গ্রিনহাউস গ্যাস কমানো, উৎপাদন বৃদ্ধির দক্ষতা এবং জলবায়ু সহনশীল খাদ্যব্যবস্থা তৈরিতে বড় অবদান রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে।

দিনের আরেকটি উল্লেখযোগ্য সেশনে ‘ইন্ট্রগ্রেটিং উইমেন ইন দ্য ফাইট এগেইনেস্ট দি ক্লাইমেট ক্রাইসিস’ আলোচনায় নারী নেতৃত্বকে জলবায়ু শাসনব্যবস্থায় আরও গভীরভাবে যুক্ত করার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরা হয়। এখানে ব্রাজিলের নতুন প্রটোকল উপস্থাপনের পাশাপাশি আলোচনা হয় কীভাবে নারীকণ্ঠকে নীতিনির্ধারণে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে স্থায়ী করা যায়। বক্তারা বলেন, নারী নেতৃত্বকে শক্তিশালী না করলে কৃষি-খাদ্যব্যবস্থার রূপান্তর অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।

বিকালে অনুষ্ঠিত হয় দিনের সবচেয়ে উচ্চপর্যায়ের সেশন- ‘গ্লোবাল ক্লাইমেট অ্যাকশন হাই-লেভেল ইভেন্ট’। এখানে নেতারা স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেন- প্রতিশ্রুতি নয়, প্রয়োজন বাস্তব ফলাফল। ঘোষণা দেওয়া হয় একটি সম্মিলিত আহ্বানÑ ‘মুতিরাঁও’, অর্থাৎ সমাজ, সরকার, গবেষক, কৃষক ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে দ্রুতগতিতে। নেতারা বলেন, যদি অবিলম্বে ভূমি পুনরুদ্ধার, খাদ্য উৎপাদনে অভিযোজন, নারী নেতৃত্ব, আফ্রো-বংশোদ্ভূত জনগোষ্ঠীর অধিকার এবং বৈজ্ঞানিক সমাধানের সমর্থনে কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তাহলে পরবর্তী প্রজন্মকে ভয়াবহ খাদ্য ও পরিবেশ সংকটের মুখোমুখি হতে হবে।

দিনশেষে বেলেমের আলোচনায় একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে- কপ-৩০ এখন শেষ মুহূর্তের দর কষাকষিতে ব্যস্ত। তবে সবাই চেষ্টা করছে, পৃথিবীকে রক্ষার জন্য একটি কার্যকর সমাধানে পৌঁছাতে।