ডেঙ্গু আতঙ্ক ও জনসচেতনতা

সাইফুজ্জামান
১৯ নভেম্বর ২০২৫, ০৮:৪১
শেয়ার :
ডেঙ্গু আতঙ্ক ও জনসচেতনতা

বাংলাদেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। জনসাধারণের মাঝে আতঙ্ক বিরাজ করছে। মশার রাজত্বে মানুষ অসহায় বোধ করছে। দিনের বেলা মশারি টানিয়ে ঘুমানো, স্বচ্ছ পানি জমে এমন স্থান পরিষ্কার রাখা- এসব হলো মশকমুক্ত রাখার স্বাভাবিক শর্ত। নগরে সবুজ গাছপালা কমে গেছে। মশকমুক্ত রাখার জন্য ব্যাঙ দেখতে পাওয়া যায় না। আবাসিক ব্যবস্থাপনার জন্য যত্রতত্র গর্ত খোঁড়ার কাজ চলে। এসব জায়গা মশার বিচরণক্ষেত্র। টব, এসি, ফ্রিজের পানি জমে থাকা স্থানে মশা তার বংশ বিস্তার করছে। খোলাবাজারে খাবার বিক্রি থেকে শুরু করে খোলা আকাশের নিচে যত্রতত্র মানুষ বাস করছে মশার সঙ্গে।

দুই সিটি করপোরেশনের নিয়ম করে মশা মারার নিত্যনতুন উদ্যোগ না থাকায় মশাসহ নানা রোগ বিস্তারী অনুষঙ্গ যুক্ত হয়ে মানুষ অসহায় দিন যাপন করছে। খাবারে ভেজাল, নিত্যনতুন ফরমালিন ও ওষুধে খাবার পাকানো হয়। কলা, ফল, মাছ ও সবজিতে মেশানো বিষাক্ত দ্রব্য মানুষ খাচ্ছে। টাইফয়েড, জন্ডিস, বসন্ত (পক্স), চোখের অসুখ, মাথাধরা, জ্বরসহ বিভিন্ন রোগের সংক্রমণ মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। হাসপাতালগুলোতে ব্যবসা বন্ধ হয়নি। রক্তের ও বিভিন্ন রোগের রকমারি পরীক্ষা চলছে। ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলা শহরে ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা হাজারের ওপর। এখন কিছুটা কমতে শুরু করেছে। উৎকণ্ঠা কমেনি। দিন আনে দিন খায় এমন মানুষের সংখ্যা এ দেশে বেশি। শহরে গিয়ে চিকিৎসা নেওয়ার সংগতি অনেকেরই নেই।

ঢাকা শুধু নয়, জেলা শহর থেকে শুরু করে গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়ে গিয়েছিল। সচেতনতা ও প্রতিরোধ কর্মসূচি মহামারি আকার ধারণের আগে সহনীয় মাত্রায় নিয়ে এসেছে। পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে রাজধানীসহ সারাদেশে সরকারি, বেসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত হাসপাতালে ভর্তি নতুন রোগীর সংখ্যা রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। বিভিন্ন হাসপাতালের চিত্র ভয়াবহ। সাধারণ রোগীরা মশারি টানিয়ে ঘুমাচ্ছে। কিন্তু সাধারণ বাঙালিরা মশারি টানিয়ে ঘুমাতে অভ্যস্ত নয়। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীকে কামড় দেওয়া মশা সুস্থ মানুষকে কামড় দিলে ডেঙ্গু রোগের বিস্তার হতে পারে। সে কারণে বাড়িতে ও হাসপাতালে দিনের বেলায় মশারি টানানোর পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা।

ডেঙ্গুমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে নাগরিকের দায়িত্ব রয়েছে। ডেঙ্গু ভাইরাসের কোনো স্বীকৃত টিকা বা ভ্যাকসিন নেই। সুতরাং প্রতিরোধ নির্ভর করে জীবাণুবাহী মশা নিয়ন্ত্রণ এবং তার কামড় থেকে সুরক্ষার ওপর। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পাঁচটি মৌলিক দিশাসহ সংবদ্ধ একমুখী নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির সুপারিশ করেছে : (১) প্রচার, সামাজিক সক্রিয়তা এবং জনস্বাস্থ্য সংগঠন ও সম্প্রদায়গুলোকে শক্তিশালী করতে আইন প্রণয়ন, (২) স্বাস্থ্য ও অন্য বিভাগগুলোর মধ্যে সহযোগিতা (সরকারি ও বেসরকারি), (৩) সম্পদের সর্বাধিক ব্যবহার করে রোগ নিয়ন্ত্রণে সুসংবদ্ধ প্রয়াস, (৪) যে কোনো হস্তক্ষেপ যাতে সঠিক লক্ষ্যবস্তুতে হয় তা সুনিশ্চিত করতে প্রমাণভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং (৫) স্থানীয় অবস্থায় পর্যাপ্ত সাড়া পেতে সক্ষমতা বৃদ্ধি।

মশা নিয়ন্ত্রণ করার প্রাথমিক পদ্ধতি হলো এর বৃদ্ধির পরিবেশকে ধ্বংস করে ফেলা। পানির আধার খালি করে অথবা কীটনাশক প্রয়োগ করে অথবা সেসব জায়গায় বায়োলজিক্যাল কন্ট্রোল এজেন্ট প্রয়োগ। স্বাস্থ্যের ওপর কীটনাশকের কুপ্রভাব এবং কন্ট্রোল এজেন্টের ব্যয়বহুলতার কথা মাথায় রেখে পরিবেশ শোধনের মাধ্যমে জমা পানি কমানোটাই নিয়ন্ত্রণের সবচেয়ে ভালো উপায়। মানুষজন পুরো শরীর ঢাকা পোশাক পরে, বিশ্রামের সময় মশারি ব্যবহার করে এবং কীট প্রতিরোধক রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করে মশার সংক্রমণ দূর করা সম্ভব।

পানির বোতল, ডাবের খোসা, টব ও বিভিন্ন কনটেইনারে পানি জমতে দেওয়া যাবে না। বর্ষা মৌসুমে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করা আবশ্যক। মশার অবাধ প্রজননক্ষেত্র ধ্বংস করতে হবে। সিটি করপোরেশন মশক নিধনে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারে। আকাশ থেকে মশা মারার ওষুধ ছিটাতে হবে।

এডিস মশা সকালে ও সন্ধ্যার আগে কামড়ায়। ওই সময় বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে। মশারি টানাতে হবে। শরীর ঢেকে রাখে এমন পোশাক পরতে হবে। অন্তত সপ্তাহে এক দিন বাসাবাড়ি পরিষ্কার করতে হবে। টায়ার, ফুলের টব, পানির বোতল, ফ্রিজ-এসির পানি জমে থাকা স্থান, খেলার মাঠ ও ভবন পরিষ্কার রাখতে হবে। ডেঙ্গু রোগ মহামারী রূপ নেওয়ার আগে বিশেষ সতর্কতা ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। ক্লাব, সংগঠন, সরকারি-বেসরকারি সংস্থা এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। ম্যাজিস্ট্রেটসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারি বাড়াতে হবে। যাদের উদাসীনতা ও দায়িত্বহীনতার কারণে যত্রতত্র মশার প্রজনন বাড়ছে তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। জানা গেছে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও বাসাবাড়িতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ইতোমধ্যে হানা দিয়েছে।

রোগের প্রাদুর্ভাবে নতুনভাবে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে বাংলাদেশের সব নাগরিককে। জনসচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সামাজিক প্রতিরোধ জোরালো করতে না পারলে নাগরিক অস্তিত্ব বিপন্ন হবে। সর্বোপরি, সাধারণ জ্বর মনে করায় অবহেলা করে অনেক ডেঙ্গু রোগী বিলম্বে চিকিৎসকের কাছে সেবা নিতে যায়। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর প্লাটিলেট কমতে শুরু করে, তাতে নানা সংকট সৃষ্টি হয়।


সাইফুজ্জামান : প্রাবন্ধিক