ট্রাইব্যুনালে ৫৭ মামলায় রায়, ছয়জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য বাংলাদেশে ২০১০ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছে। সবশেষ ২০২৪ সালের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার জুলাইয়ের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য পুনর্গঠন করে একই ট্রাইব্যুনাল। পুনর্গঠনের আগে ১৫ বছরের বেশি সময়ে মুক্তিযুদ্ধাকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের মোট ৫৭টি মামলার রায় দিয়েছিলেন ট্রাইব্যুনাল। এর মধ্যে সব আইনি প্রক্রিয়া শেষে ছয়জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে।
জানা গেছে, ২০১০ সালের ২৫ মার্চ যাত্রা শুরুর পর ট্রাইব্যুনাল থেকে দণ্ডিত ১৮৯ আসামির মধ্যে ১৪০ জনকে দেওয়া হয়েছে মৃত্যুদণ্ড। ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর আপিল শেষে এ পর্যন্ত ছয়জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে, তাঁদের মধ্যে পাঁচজন ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর নেতা, একজন বিএনপির। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের আরও ৩০টি মামলা ট্রাইব্যুনালে রয়েছে। তবে অন্তর্বর্তী সরকার জুলাই হত্যার বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করার পর আপাতত যুদ্ধাপরাধের কোনো মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ হচ্ছে না। এ ছাড়া ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে আসামিদের করা ৫০টিরও বেশি আপিল সর্বোচ্চ আদালতে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, গত বছরের জুলাইয়ের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনালে এখন পর্যন্ত গত এক বছরে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ১০টি। আর পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থায় জুলাই গণঅভ্যুত্থানের অন্তত ৩৭টি মামলার তদন্ত চলছে।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা এবং তাদের সহযোগী রাজাকার বাহিনী জনগণের প্রতি যে নৃশংসতা চালিয়েছিল, তাদের বিচারের উদ্দেশ্যে ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে এ আইনে সংশোধনী আনে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ। ‘দ্য ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস (ট্রাইব্যুনালস) অ্যাক্ট, ১৯৭৩’ আইনের অধীনে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের আটক, গ্রেপ্তার, বিচার এবং সাজা দেওয়া হয়। ১৯৭৩ সালের এই আইনটি মূলত বাংলাদেশ কোলাবরেটর (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) অর্ডার ১৯৭২-কে প্রতিস্থাপিত করেছে।
আরও পড়ুন:
আকতার পারভেজ সর্বোচ্চ ভোটে সিএসই পরিচালক
স্বাধীনতার ৩৯ বছর পরে ২০১০ সালের ২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল, তদন্ত সংস্থা এবং আইনজীবী প্যানেল গঠন করে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। ঢাকায় পুরনো হাইকোর্ট ভবনে ট্রাইব্যুনালের বিচার কাজ শুরু হয়। ট্রাইব্যুনাল গঠনের বছরই জুলাই মাসে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলার আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়। প্রথমে একটি ট্রাইব্যুনালে বিচারিক কার্যক্রম চললেও পরে ২০১২ সালের মার্চে আরেকটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়।
জামায়াতে ইসলামীর রুকন আবুল কালাম আযাদ, যিনি বাচ্চু রাজাকার নামেও পরিচিত, তাঁর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায়ই ছিল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেওয়া প্রথম রায়। ২০১৩ সালের ২১ জানুয়ারি ওই মামলার রায় দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। এ ছাড়া একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াত নেতা মতিউর রহমান নিজামী, আব্দুল কাদের মোল্লা, আলী আহসান মুজাহিদ, মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, মীর কাশেম আলীকে মৃত্যুদণ্ড দেন ট্রাইব্যুনাল, যা কার্যকর হয়েছে। একাত্তরে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের অপরাধে মৃত্যুদণ্ড হয় আলবদর নেতা চৌধুরী মঈনুদ্দীন এবং আশরাফুজ্জামান খানের। তবে পলাতক অবস্থায় এ মামলায় বিচার হয়। এ ছাড়া বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরকেও মৃত্যুদণ্ড দেন ট্রাইব্যুনাল, যা কার্যকর হয়েছে। ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর কারাগারে থাকা অবস্থায় মারা গেছেন জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযম ও দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, জাতীয় পার্টির নেতা এবং সাবেক প্রতিমন্ত্রী সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সার। এ ছাড়া এটিএম আজহারুল ইসলাম ও বহিষ্কৃত আওয়ামী লীগ নেতা মোবারক হোসেন সম্প্র্রতি আপিলে মুক্তি পেয়েছেন।
গত বছর জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থান অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পরে ২০২৪ সালের অক্টোবরে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হয়। গত বছরের নভেম্বরে ট্রাইব্যুনাল আইনে বেশ কিছু সংশোধনী আনা হয়। পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় প্রথম মামলা (মিসকেস বা বিবিধ মামলা) হয়। গত বছরের ১৭ই অক্টোবর পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনালের প্রথম বিচার কার্যক্রম অনুষ্ঠিত হয়। ওই দিনই শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে এ মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন ট্রাইব্যুনাল। তখন শেখ হাসিনাই মামলাটির একমাত্র আসামি ছিলেন। পরে চলতি বছরের মার্চে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং সাবেক আইজিপিকে এ মামলায় আসামি করতে প্রসিকিউশনের করা আবেদন মঞ্জুর করে ট্রাইব্যুনাল। এই মামলায় শেখ হাসিনাসহ আসামিদের বিরুদ্ধে পাঁচটি অভিযোগ এনে প্রতিবেদন জমা দেয় তদন্ত সংস্থা। শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন এ মামলায় পলাতক আসামি। বাকি একমাত্র গ্রেপ্তারকৃত আসামি হলেন পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন। তিনি এই মামলায় রাজসাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দিয়েছেন। বিচারিক কার্যক্রম শেষ হওয়ার পর গতকাল রায় ঘোষণা করেছে ট্রাইব্যুনাল। শেখ হাসিনা ছাড়াও আওয়ামী লীগ সরকারের বেশ কয়েকজন মন্ত্রী, নেতাকর্মী, সরকারি কর্মকর্তা, পুলিশ কর্মকর্তা এবং সাবেক ও বর্তমান দুই ডজন সেনা কর্মকর্তা ট্রাইব্যুনালের একাধিক মামলার আসামি।
আরও পড়ুন:
বৃহত্তম হিমশৈল