সম্পর্কের নতুন চ্যালেঞ্জ
একটা সময় আসে, যখন ঘরের ছোট্ট শিশুটি যেন অচেনা হয়ে যায়। হঠাৎ মনে হয়, সে ধীরে ধীরে দূরে সরে যাচ্ছে এবং সম্পর্কের ভাষা বদলে যাচ্ছে। টিনএজ বয়স ১৩ থেকে ১৯ বছরের এই সময় শুধু পরিবর্তনের নয়, চ্যালেঞ্জেরও। শরীর, মন ও চিন্তায় ঘটে বড় রকমের রূপান্তর। বন্ধুত্ব, প্রথম ভালোবাসা, ছোট ছোট আবেগ- সবই হঠাৎ তার জীবনের নতুন জটিলতায় রূপ নেয়। বাবা-মায়ের হৃদয় দগ্ধ হয়; মনে হয়, এই ছোট্ট হাতটি যেন ধীরে ধীরে তাদের হাতছাড়া অন্য কোনো পথে এগোচ্ছে। টিনএজ সম্পর্কের এই নতুন অধ্যায় স্বপ্ন, উত্তেজনা এবং অনিশ্চয়তার এক অদ্ভুত মিলন। তাই এই সময়ে অভিভাবকের দায়িত্ব শুধু বাবা-মা হওয়া নয়, বরং শিক্ষক, পরামর্শদাতা এবং বন্ধু হয়ে পাশে থাকা।
এই বয়সে সন্তানরা নিজের মতো করে ভাবতে শুরু করে, সিদ্ধান্ত নিতে চায়, প্রশ্ন করে, কখনও প্রতিবাদও করে। অনেক সময় এসব আচরণকে আমরা ‘অসভ্যতা’ মনে করি, অথচ এগুলোই আত্মপরিচয়ের খোঁজের অংশ। টিনএজারদের সবচেয়ে বড় চাওয়া স্বাধীনতা- নিজের পোশাক, বন্ধু বা সময় সবকিছু নিয়ে নিজস্ব সিদ্ধান্ত নেওয়ার আকাক্সক্ষা। এই স্বাধীনতা দিতে হবে, তবে দায়িত্ব শেখানোর মাধ্যমে। অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ তাদের বিদ্রোহী করে তোলে, আবার পুরোপুরি ছেড়ে দিলে বিভ্রান্ত হয়। তাই দরকার ভারসাম্য- যেখানে স্বাধীনতার সঙ্গে সীমারেখা ও দায়িত্ব দুটোই স্পষ্ট।
সন্তানের সঙ্গে কথা বলুন- প্রতিদিন অন্তত কিছু সময় একসঙ্গে কাটান। স্কুল, বন্ধু, আগ্রহ কিংবা ছোটখাটো বিষয় নিয়েও আলাপ হোক। পরামর্শ দেওয়ার আগে শুনে নিন মন দিয়ে। সন্তান যেন মনে করে, আপনি তাকে বিচার করতে নয়, বুঝতে চান। ‘তুমি ভুল করেছ’ না বলে বলুন, ‘চলো দেখি, একসঙ্গে কীভাবে ঠিক করা যায়।’ এই সামান্য পরিবর্তনই তৈরি করবে বোঝাপড়ার এক গভীর সেতুবন্ধ। টিনএজ বয়সে আত্মসম্মান খুব নাজুক। ‘ও পারল, তুমি পারলে না কেন?’ এই একটিমাত্র তুলনাই তাদের মনে আঘাত দেয়। তাই তুলনা নয়, উৎসাহই হোক আপনার হাতিয়ার। ছোট ছোট সাফল্যে প্রশংসা করুন, ব্যর্থতায় পাশে থাকুন। শেখান, ভুল করা অপরাধ নয়- শেখারই অংশ। যে সন্তান নিজের ওপর বিশ্বাস রাখতে শেখে, ভবিষ্যতে সে-ই সবচেয়ে দৃঢ়ভাবে দাঁড়াতে পারে। এই বয়সে রাগ, অভিমান, হতাশা বা চুপচাপ থাকা- সবই স্বাভাবিক। এই সময়ে রাগ বা শাসন নয়, বরং ধৈর্য ও বোঝাপড়াই হতে পারে সবচেয়ে বড় সহায়। শান্তভাবে বোঝান কেন কোনো আচরণ গ্রহণযোগ্য নয়। ভালোবাসা ও যুক্তি দিয়ে বোঝাতে পারলে, সন্তানও তা সহজে গ্রহণ করে।
আরও পড়ুন:
বিশেষজ্ঞ যা বলেন
আজকের টিনএজাররা বড় হচ্ছে মোবাইল, ইন্টারনেট ও সোশ্যাল মিডিয়ার ভেতর। অনলাইন প্রভাব, বন্ধুত্বের চাপ বা ট্রেন্ডের দৌড়ে তারা সহজেই বিভ্রান্ত হতে পারে। তাই নিষেধ নয়- বোঝান ও শেখান সচেতনতা, ইন্টারনেট ব্যবহারে নিরাপত্তার নিয়ম শেখান, সময় বেঁধে দিন যুক্তি দিয়ে, জোর করে নয়, অনলাইন ট্রেন্ডে অন্ধভাবে না ভেসে নিজের চিন্তায় সিদ্ধান্ত নিতে উৎসাহ দিন। ফ্যাশন এবং হেয়ারস্টাইলে নিজের ব্যক্তিত্ব প্রকাশ করতে চায়। এখানে অভিভাবকের ভূমিকা নিয়ন্ত্রণ নয়, বরং দিকনির্দেশনা দেওয়া। তাদের পছন্দকে সম্মান করুন, তবে পরিপাটি ও মার্জিতভাবে সাজতে শেখান, আলোচনার মাধ্যমে ঠিক করুন কোন পোশাক কোথায় মানায়, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা ও নিজের শরীরকে ভালোবাসা শেখান। সবচেয়ে জরুরি, সন্তান যেন বিশ্বাস করে- আমি যেমন, তেমনই সুন্দর। অনেক কিশোর-কিশোরী একাকিত্ব বা উদ্বেগে ভোগে, কিন্তু প্রকাশ করতে পারে না। খেয়াল রাখুন- খাবারের রুচি কমে যাওয়া, পড়াশোনায় মন না থাকা, হঠাৎ চুপচাপ হয়ে যাওয়া- এসব হতে পারে সতর্ক সংকেত। প্রয়োজনে কাউন্সেলর বা মনোবিজ্ঞানীর সহায়তা নিতে দ্বিধা করবেন না। টিনএজ সন্তানকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা যায় না, আবার একদম ছেড়েও দেওয়া যায় না। তাই প্রয়োজন বোঝাপড়া, ধৈর্য ও ভারসাম্যের। তাদের মতামতকে সম্মান দিন, সীমারেখা স্পষ্ট রাখুন।
সন্তানকে সামলানো মানে যুদ্ধ নয়- এটি ভালোবাসা ও সহমর্মিতার এক যাত্রা। টিনএজের ঝড় একদিন থেমে যায়, যদি পাশে থাকে বোঝাপড়া, সম্মান আর নিঃশর্ত ভালোবাসা। সন্তানকে নিয়ন্ত্রণ নয়- নেতৃত্ব দিন, যাতে সে নিজের পথ খুঁজে নিতে পারে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে, ভালোবাসায় ভর করে।
আরও পড়ুন:
কোনো বাধাই দমাতে পারেনি জান্নাতুলকে
টিনএজ সন্তানের সঙ্গে সম্পর্কটা অনেকটা নরম সুতোয় বাঁধা- একটু টান দিলেই ছিঁড়ে যায়, আবার একটু যত্ন পেলে আরও দৃঢ় হয়। তারা যখন দূরে সরে যায় মনে হয়, হয়তো ভালোবাসা কমে গেছে, অথচ সত্যি হলো- তারা নিজের পৃথিবী খুঁজে ফিরছে। এই সময়টায় অভিমান নয়, দরকার একটু ধৈর্য, একটু নিঃশর্ত ভালোবাসা। শেষ পর্যন্ত সম্পর্কটা টিকে থাকে তখনই, যখন মা-বাবা বোঝাতে পারেন- ‘তুমি যেখানেই থাকো, আমার ভালোবাসা তোমার সঙ্গেই আছে।’