কন্যাসন্তানের প্রতি বৈষম্য নয়

নিশাত তানিয়া
২৬ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০
শেয়ার :
কন্যাসন্তানের প্রতি বৈষম্য নয়

সমাজে আমরা নিজেদের আধুনিক মানুষ ভাবলেও কন্যাশিশুর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন খুব বেশি একটা ঘটেনি। আজকের কন্যাশিশুই আগামীর নারী ও মা। একটি সমাজ বা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সবচেয়ে বড় লক্ষণ নারী ও পুরুষ সমানভাবে এগিয়ে যাওয়া। আর আজকের কন্যাশিশুর সঠিক যত্ন, নিরাপত্তা, ভালোবাসাই এ উন্নতি সম্ভব।

অনেক কন্যাশিশুই জন্মের পর ইচ্ছাকৃতভাবে পুষ্টিকর খাবার থেকে বঞ্চিত হয়। কিন্তু শিশুর মেধার বিকাশ ছোটবেলাতেই হয়। তাই শিশুকাল থেকে যদি কন্যাসন্তানের পুষ্টি নিশ্চিত করা না হয়, তা হলে পরবর্তীকালে সেও একটি সুস্থ জীবন পাবে না। এর পরবর্তী ধাপ আসে শিক্ষা। সেখানেও কন্যাশিশুকে স্কুলে দেওয়া হচ্ছে না ঠিকমতো, শেখানো হচ্ছে শুধু ঘরের কাজ। পাশেই তার ভাই নিয়মিত শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ পাচ্ছে। এর মূল কারণ হিসেবে তারা ধরেই নেয় খুব অল্পবয়সে বিয়ে দিয়ে দেওয়ার কথা। জনবিজ্ঞানী আরএম ডিংকেল ‘এডুকেশন অ্যান্ড ফার্টিলিটি ইন দ্য ইউএসএ’ নামক এক নিবন্ধে ষাটের দশকে মার্কিন জনগণের মধ্যে শিক্ষা ও প্রজননের সম্পর্ক খুঁজতে গিয়ে দেখেন, পুরুষের তুলনায় নারীর শিক্ষা প্রজননের সঙ্গে বেশি সম্পর্কযুক্ত।

আমাদের দেশে বাল্যবিয়ের ছায়া অনেকটায় গ্রাস করে রেখেছে, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে। ইউনিসেফের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, এখনো ৪৮ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয় ১৮ বছরের নিচে। এ ক্ষেত্রে বেশিরভাগ নারীরই তাদের মতামত নেওয়ার প্রয়োজন মনে করে না পরিবারগুলো। ইউনিসেফের আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা সমাজসেবা অধিদপ্তর ‘চাইল্ড সেনসিটিভ সোশ্যাল প্রটেকশন ইন বাংলাদেশ (সিএসপিবি)’ শীর্ষক প্রকল্প ২০১৬ সাল থেকে কার্যক্রম বাস্তবায়ন করেছে। এ প্রকল্পের স্বল্পমেয়াদি উদ্দেশ্য হলো নারী, শিশু ও যুব সম্প্রদায়ের কার্যকর সুরক্ষা এবং উপযুক্ত সেবাপ্রাপ্তির মাধ্যমে নির্যাতন, অবহেলা, শোষণ ও পাচার বিলোপ সাধন করা।

তবে আমার কথা এই যে, শিক্ষার মাধ্যমে নারীর জ্ঞান ও দক্ষতা বৃদ্ধি করে কন্যাশিশুর প্রতি বৈষম্য এবং বঞ্চনা দূরীকরণের জন্য সরকার প্রত্যন্ত অঞ্চলেও নানা কর্মসূচি শুরু করেছে। মহিলা ও শিশুবিষয়ক অধিদপ্তরের অধীন দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে নেওয়া হয়েছে নানা কর্মসূচি। নারী ও তাদের সন্তানদের করা হচ্ছে শিক্ষাস্বাস্থ্য এবং পুষ্টি সম্পর্কে সচেতন। বাংলাদেশে যেহেতু অর্ধেকই নারী, সেহেতু দেশের ভারসাম্য উন্নয়নের জন্য পুরুষের পাশাপাশি নারীর স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ খুবই জরুরি। তবে সবকিছুর উপরে হতে হবে নিজেকে সচেতন ও পরিবারকে বের করতে হবে অন্ধকার চিন্তাভাবনা থেকে। কন্যাশিশুর প্রতি বৈষম্যের সবচেয়ে প্রথম ধাপ হিসেবে সন্তান ছেলে বা মেয়ে হবেÑ এতে যে নারীর কোনো হাত নেই; এটি বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত, তা বুঝতে হবে। তাই শিশু গর্ভে থাকাকালেই যদি নানা ধরনের অত্যাচারের শিকার হয়, তা হলে অঙ্কুরেই বিনষ্ট ছাড়া আর কিছুই বলা যাবে না। পরিবার থেকে বৈষম্য দূর করতে হলে সন্তানদের সমান চোখে দেখতে হবে। আলাদাভাবে দেখলে সন্তানদের মধ্যেই হিংসা-বিদ্বেষ তৈরি হয়। ফলে পারিবারিক অশান্তিও সৃষ্টি হয়। কন্যাশিশুর প্রয়োজন শুনতে হবে। তার মতামত গ্রহণ করতে হবে প্রতিটি কাজে।

বর্তমানে এসব বৈষম্য কিছুটা কমেছে। প্রাথমিক শিক্ষার হার যেমন বেড়েছে, তেমনি ঝরে পরা শিক্ষার্থীর সংখ্যাও অনেক কমেছে। আর বৈষম্য কমানো সম্ভব হয়েছে বলেই দেশের অনেক সাংবাদিক, প্রশাসনিক, এমনকি ফায়ার সার্ভিসের মতো চ্যালেঞ্জিং পেশায় নারীদের ভূমিকা চোখে পড়ার মতো। এই বৈষম্য পুরোপুরি দূর করতে পারলেই আমাদের আজকের কন্যাশিশু আগামীর জন্য দেশের গর্ব হয়ে উঠবে।