সাইবার বুলিংয়ের আঘাতে ভেঙে যায় কিশোরীর স্বপ্ন

ফুলকুনি আহমেদ
১৬ নভেম্বর ২০২৫, ০৮:৪৩
শেয়ার :
সাইবার বুলিংয়ের আঘাতে ভেঙে যায় কিশোরীর স্বপ্ন

স্ক্রিনের পেছনে যা ঘটে, সব সময় আমরা দেখতে পাই না। তাতে যে ক্ষতটা জন্মায় তা চোখে দেখা যায় না। কিন্তু মন, স্বপ্ন সেই সঙ্গে আত্মবিশ্বাস এবং জীবনের ইচ্ছেও ভেঙে পড়ে। আজকের কিশোরী প্রজন্ম সোশ্যাল মিডিয়া ও ইন্টারনেটের মাধ্যমে শিক্ষা, বন্ধু ও বিনোদন পাচ্ছে; তবু একই পথে অনাগত ভয়- সাইবার বুলিং তাদের ধীরে ধীরে সামাজিক ও মানসিকভাবে একা করে দিচ্ছে। আজকের লেখা কোনো ব্যক্তির একার নয়, সেসব ভিকটিমদের যারা চুপ হয়ে যায়, তাদের গল্প, তাদের পরিণতি এবং সুরক্ষার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে।

সাইবার বুলিং শুরু হয় এক টুকরো মেসেজ দিয়ে, একটা কটূক্তি কিংবা একটি অপমানজনক ছবি শেয়ার করে। কিন্তু ধীরে ধীরে তা বাড়ে : গোপনে খোলা প্রসঙ্গ, ধরে থাকা গুজব, গ্রুপে তীব্র ট্রলিং- সবকিছু একসঙ্গে কাজ করে কিশোরীর আত্মমর্যাদা ধ্বংস করতে। আত্মবিশ্বাস দুর্বল হলে প্রথমেই নষ্ট হয় মনোবল, স্কুলে বা কলেজে যাওয়ার ইচ্ছা কমতে থাকে। কখনও কেউ কেউ আবার মিশে উঠতে পারে না- বন্ধুদের মধ্যে নিজেকে আলাদা মনে করে। অনেক সময়ই পরিবারের কাছে সে লজ্জা বা ভয় নিয়ে কথা বলতে পারে না। ফলাফল : পরীক্ষার প্রতি অনীহা, ক্লাসে অংশগ্রহণ কমে যাওয়া এবং বহু ক্ষেত্রে শিক্ষাজীবনই বন্ধ হয়ে যায়।

একজন কিশোরী যখন অনলাইন অপমানের শিকার হয়, তখন তার মানসিক অবস্থা দ্রুত খারাপ হতে পারে। ঘুমহীনতা, আত্মরক্ষার সংকোচ ইত্যাদি দেখা দেয়। যাদের বাড়তি সহানুভূতি বা মানসিক সহায়তা নেই, তাদের ধরাছোঁয়ার ভয় বাড়ে; তারা সামাজিক যোগাযোগ এড়াতে শুরু করে। ক্লাসে বসে থাকা, সহপাঠীদের চোখে দেখা, কথা বলা- এসবই তাদের জন্য কঠিন হয়ে ওঠে। অনেকের ক্ষেত্রে এ অবস্থা আত্মহত্যার ভাবনা বা চেষ্টায় পৌঁছে যায়। কিশোরী যখন মনে করে ‘আমি একা’ বা ‘কারও কাছে জানালে খারাপ দেখাবে’, তখন বিপজ্জনক সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ হয়ে পড়ে। নেট ব্যবহারে সতর্ক না হলে ছোট ছোট ভুলও বড় বিপদে পরিণত হতে পারে। নানা অ্যাপে নাম-ঠিকানা, স্কুলের তথ্য, বাড়ির রুটিন খোলামেলাভাবে শেয়ার করলে, অপরিচিতদের হাতে চলে যায় শিকার করার উপায়। ফেক আইডি তৈরি করে ছবি বিকৃত করা, গোপনীয়তা ভঙ্গ করে কোনো কটূক্তি ছড়ানো- এসবই দ্রুত বিস্তার লাভে সুবিধা হয়। তাই কিশোরীকে শুধু সাবধান করাই যথেষ্ট নয়; তাকে শেখাতে হবে কী শেয়ার করা নিরাপদ, কী নয়; কীভাবে প্রাইভেসি সেটিং ব্যবহার করতে হয়; কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে গেলে দ্রুত রিপোর্ট কীভাবে করতে হয়- এসব বিষয় পরিবার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে নিয়ম করে শেখাতে হবে।

সমস্যার মাত্রা একান্তই ব্যক্তিগত নয়- এটি সামাজিক সমস্যা। বহু কিশোরী স্কুল-কলেজ ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়- কখনও লজ্জা, কখনও অনুন্নত মানসিক অবস্থা ও নিরাপত্তাহীনতাজনিত কারণে। এভাবে শিক্ষাবঞ্চিত হলে তার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়ে; স্বনির্ভরতার পথে বাধা পড়ে; সমাজে পুরনো বৈষম্য আরও গভীর হয়। তাই কেবল ব্যক্তিগত সতর্কতা নয়, প্রয়োজন সামাজিক প্রতিরোধ: বিদ্যালয়ে সাইবার বুলিং শিক্ষাদান, কাউন্সেলিং সেন্টার এবং দ্রুত আইনি সুরক্ষা ব্যবস্থা। ঘর থেকেই শুরু করতে হবে। বিরক্ত না হয়ে অভিভাবকরা যদি কিশোরীদের নেট ব্যবহার নিয়মিত অনুসরণ ও কথাবার্তা বলেন, তাহলে শিশুরা সহজেই সমস্যা খুলে বলতে পারবে। স্কুলে শিক্ষক-শিক্ষিকাদেরও সতর্ক থাকা জরুরি- শিক্ষার্থীদের অনলাইন আচরণ, সীমা নির্ধারণ এবং সহপাঠীর প্রতি সম্মানের পরামর্শ দেবেন। সমাজের বিভিন্ন স্তরেও সচেতনতা বাড়াতে হবে; যারা ট্রলিং করে বা গুজব ছড়ায় তাদের বিরুদ্ধে সামাজিক অনুশাসন জরুরি।

এই সমস্যা মোকাবিলায় আমাদের প্রত্যেকের ভূমিকা জরুরি। কিশোর-কিশোরীকে বলুন- তুমি একা নও; চুপ থাকা মানে সমস্যার সমাধান নয়; সাহায্য চাইলে তুমি শক্তিশালী। ডিজিটাল শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে আবেগগত শিক্ষা চালু করতে হবে- নিরাপদ নেট ব্যবহার, মানসিক স্থিতি রক্ষা ও আত্মসম্মান পুনঃপ্রতিষ্ঠার পাঠ। যদি আমরা দ্রুত সচেতন হই, যদি পরিবারের কথা শুনি, স্কুল ব্যবস্থা শক্তভাবে চালু করি এবং আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করি- তবে হয়তো অনেক স্বপ্ন ভেঙে পড়া রোধ করা যাবে, অনেক কিশোরীর আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে তাদের শিক্ষা ও জীবন রক্ষায় সফল হওয়া যাবে।