বিহারের মতোই অবস্থা কি পশ্চিমবঙ্গেও হবে?
সব হিসাব-নিকাশ পাল্টে দিল বিহার বিধানসভার নির্বাচনের ফল। এ যেন আলাউদ্দিনের আশ্চর্য প্রদীপের মতোই। তাই কি? না, এই ফলাফলের মধ্যেও রয়েছে বাস্তব ভিত্তি। যদিও রাহুল গান্ধী-তেজস্বী যাদব ও বামপন্থি দলগুলোর এসআইআর নিয়ে মহাগাঁটবন্ধনের ভোটাধিকার যাত্রা জনসমুদ্র দেখে তো কেউ ভাবেনি নীতিশ কুমারের জনতা দল ইউ এবং বিজেপির এনডিএ জোট এই অভূতপূর্ব ফলাফল করবে। সাধারণভাবে বিহারের রক্তপাতহীন বিধানসভা নির্বাচনে যেখানে ভোটের শতকরা হিসাব বাড়ে, সেখানে সাধারণভাবে শাসকের হার হয়। কিন্তু এ বছর বিহারের নির্বাচন হয়েছে দুদফায়। ২৪৩টি আসনের প্রথম দফায় ১২১টি আসন ও দ্বিতীয় দফায় ১২২ আসনে ভোট হয়েছে। সেখানে ভোট পড়েছে গড়ে প্রায় ৬৭ শতাংশ। শাসক জোটের কপালে ভাঁজ পড়বে বলেই রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের ধারণা ছিল অনেকখানিই। ২০২০ সালে যেখানে বিহারে ভোট পড়েছিল ৫৭ শতাংশ, সেখানে ২০২৫ বিধানসভার ভোটে ভোট পড়েছে ৬৭ শতাংশ। আর ফলাফলে দেখা গেল নীতিশ কুমার ও বিজেপির এনডিএ জোটের জয়জয়কার। এ কোন মন্ত্রে বা কোন কৌশলে? ২০২৬ সালের পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে তার প্রভাব পড়বে? এটাই এখন মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন। বিজেপির লক্ষ্য হলো, ২০২১ সালে বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে সেই সুযোগ কাজে লাগাতে পারেনি দুডজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে প্রচারে এনেও। স্বয়ং মোদিজি বা অমিত শাহও ছিলেন। বহুদিন থেকেই পশ্চিমবঙ্গকে আরও একটা কাশ্মীর করতে চায় বিজেপি। পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাংশের জেলাগুলো নিয়ে পশ্চিমবঙ্গকে ভাগ করে পৃথক উত্তরবঙ্গ করতে চায়, তেমনি মুর্শিদাবাদ ও মালদহকে নিয়ে পৃথক কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল করতে চায় বিজেপি। তার ওপর বিহারের মতোই এসআইআর পশ্চিমবঙ্গেও দেড় কোটি মানুষকে ভোটারহীন করে কাজটাকে সহজ করতে চায় বিজেপি। যদিও বিহারে ৬৭ লাখ মানুষ ভোটারহীন হয়েছেন। পরে সেটা হয় প্রায়ই ৫০ লাখ কাটাকুটি করে। বিহারে এই এসআইআরের পূর্ণ রাজনৈতিক লাভটা এনডিএ জোট পেয়েছে।
আমরা একটু রাজনৈতিক অঙ্কের দিকে গেলে কারচুপিটা সহজেই ধরতে পারব। বিহারে তেজস্বী যাদবের আরজেডি দলের প্রাপ্ত ভোট ১.৮ কোটি, প্রাপ্ত আসন মাত্র ২৫। বিজেপির প্রাপ্ত ভোট ৯৬ লাখ, প্রাপ্ত আসন ৯১। নীতিশ কুমারের জেডিইউ-এর প্রাপ্ত ভোট ৯০ লাখ, প্রাপ্ত আসন ৮৩। আবার বিহারে নির্বাচন কমিশনের ঘোষণামতে, এসআইআরের পর বিহারের মোট ভোটার সংখ্যা ৭ কোটি ৪২ লাখ। আর ভোট পড়েছে ৭ কোটি ৪৭ লাখ। বিষয়টা ভুতুড়ে নয় কি? কেন্দ্র ও রাজ্যে ডবল-ইঞ্জিনের সরকার থাকলেই কিন্তু অনেক অনিয়ম যেমন ঘটে, তেমনি অনেক হিসাব পাল্টে যায়। রাহুল গান্ধী অনেক পরে বলেছেন, বিহারে সুষ্ঠু নির্বাচন হয়নি। রাহুল গান্ধীর কথার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলছি, মহাগাঁটবন্ধনের (ইন্ডিয়া জোট) জনসভাগুলোতে জনসমুদ্র হয়েছে ঠিকই, কিন্তু ভোটের প্রতিফলন কোথায়? না, প্রতিফলন করতে দেওয়া হয়নি। কেননা সরকারটা তো ডবল ইঞ্জিনের। পুলিশ-প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশনকেও কাজে লাগালে যা হয়, বিহারেও ঠিক তাই হয়েছে। এটাই পশ্চিমবঙ্গেও করার চেষ্টা করা হবে। তার ওপর ধর্মীয় মেরুকরণ তো আছেই।
বিহার নির্বাচন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, আমাদের সাংবাদিকতা কত নিম্নমানের। কলকাতায় বসে থেকে বিহার নির্বাচনে যে রাহুলের মহাগাঁটবন্ধন জিতছে তা দেখাল। তারপর আজকের ‘প্রথম শ্রেণির দৈনিক’। সেখানে লেখা হলো মমতার দেখানো পথেই নাকি নীতিশ (বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোট নয়)। তা মমতা আর নীতিশে মিল দেখার লোভে খবরটা পড়লাম। সাংবাদিকের মতে, মিল মহিলাদের টাকা দেওয়ায়। না, সেখানেও অমিল। মমতার সরকার দিচ্ছেন মাসে মাসে পাঁচশ (এখন হাজার), যা দিয়ে এই বাজারে কিছুই হয় না। আর নীতিশ সরকার দিচ্ছে এককালীন দশ হাজার টাকা, যা দিয়ে একজন স্বনির্ভর হতে পারে। তারপরও কোনো কোনো মহলের দাবি, নীতিশজি বিধানসভার ভোটে গোপন পথে প্রতিটি পরিবারকে বাড়তি অর্থ দিয়েছেন। দেশের অর্থনীতিতে উদ্বৃত্ত সৃষ্টি করতে পারে। স্বপ্ন দেখতে পারে আরও পাঁচজনকে চাকরি দেওয়ার। দুটো কি এক হলো? আর সবচেয়ে বড় কথা, লালুপ্রসাদ/রাবড়ির আমলের যে জঙ্গলরাজ, যে ঘোটালা তা দূর করেছেন নীতিশ। রাজ্যে সুশাসন এনেছেন। আর মমতা? দুর্নীতিতে ভরা একটি রাজ্য চালাচ্ছেন, যেখানে তার গুণধর ভাইরা চাকরি চুরি থেকে কয়লা চুরি, গরু চুরি- সবকিছু করছে। লাশ পড়ছে যখন-তখন, এমনকি পঞ্চায়েত নির্বাচনেও। গ্রামবাংলায় আজ ‘উন্নয়ন’ লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছে। অপর্ণা সেন, শুভাপ্রসন্ন প্রমুখ তথাকথিত বুদ্ধিজীবী নির্বাক। যেমন নির্বাক ছিলেন দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণরত দুঃশাসনকে দেখে ভীষ্ম দ্রোণ ইত্যাদিরা।
এই নির্বাচনী ফলের সবচেয়ে বড় দিক হলো, কিষানগঞ্জ, মধুবনি, পূর্ণিয়া, আরারিয়া প্রমুখ মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে বিজেপির জয়, যা অনেক অঙ্ককে বেহিসাব করে দিয়েছে। মমতার অভ্রান্ত ভাবে বোঝা যায়, বিজেপি-জুজুর ভয় কাটছে মুসলমানদের। আর তাদের বিজেপির ভয় দেখিয়ে দিদির আঁচলে বাঁধা যাবে না। যা তৃণমূলের পক্ষে নিতান্ত ভয়ের খবর।
আরও পড়ুন:
একসঙ্গে বিষপান ৪ বান্ধবীর, মারা গেলেন দুজন
শেষ প্রশ্ন, বিহার নির্বাচনের প্রভাব কি বাংলায় পড়বে? অবশ্যই পড়বে। বিশেষত মুসলমানদের মধ্যে। কারণ তারাও তো সুশাসন আর শান্তিপূর্ণ পরিবেশই চান। তবে এখানে বিরোধীদেরও ভূমিকা আছে। তাদের স্বপ্ন দেখাতে হবে। আমি আগেই বলেছি, মাত্র হাজার টাকার অনুদান পাওয়া মানুষদের একটা বড় অংশই অখুশি। তাদের কাছে পৌঁছে দিতে হবে স্বনির্ভরতা আর স্বচ্ছ প্রশাসনের বার্তা।
মমতা প্রশাসনের সীমাহীন দুর্নীতি, তার ওপর এসআইআর বিজেপিকে নতুন সুযোগ করে দেবে কি? কেননা এই পশ্চিমবঙ্গে ৩৪ বছর ক্ষমতায় থাকা বামদের অবস্থা একরকম কোমাচ্ছন্ন। যেখানে বামশক্তি দূর্বল সেখানে তো সাম্প্রদায়িক শক্তি বেশি লাভ গোনে। এখন আরএসএসের সদর দপ্তর নাগপুর পশ্চিমবঙ্গে তাদের দুর্গাকে কতখানি দেখে সেটাও বড় প্রশ্ন। সে অনেক বিতর্কের বিষয়। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, ১৯৯৮ সালের গঠিত তৃণমূল সুপ্রীমো মমতা ব্যানার্জি বলেছিলেন, বিজেপিকে ফ্রন্টে নিয়েই বামফ্রন্টকে উৎখাত করতে হবে। ২০১১ সালে নামমাত্র বিজেপির কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছিলেন কেবল মুসলিম ভোটের জন্য। বাকি ইতিহাস পশ্চিমবঙ্গবাসী জানেন। খোদ বিজেপি সাংসদ বিচারপতি অভিজিৎ গাঙ্গুলী তো ঝুলি থেকে বিড়ালটা বের করেই দিয়েছেন। তিনি রাখঢাক না করেই বলেছেন, আমি বিজেপিতে যোগ দিয়েছিলাম পশ্চিমবঙ্গ থেকে বিজেপিকে উৎখাত করতে। কিন্তু বিজেপি বা আরএসএসের সেই মানসিকতা নেই। এটাই আমার অভিজ্ঞতা। আর বিজেপি-তৃণমূলের মধ্যস্থতা হিসেবে কাজ করছে আরএসএসের সদর দপ্তর নাগপুর। এটাই হলো অঙ্ক।
বিহারে নীতিশ কুমার বিহারের প্রশাসক হিসাবে নজর কেড়েছেন। ফলে সেখানে তেজস্বী রাহুলের মহাগাঁটবন্ধন ব্যর্থ হয়েছে। তাদের গাঁটবন্ধন মানুষের আস্থা থেকে সরে গেছে। আর তা না হলে সরল হিসাব হলো, এসআইআর। এই এসআইআর ‘তুরুপের তাস’ হবে পশ্চিমবঙ্গেও।
আরও পড়ুন:
দিলীপ ঘোষকে ‘চোর’ বললেন বাবুল সুপ্রিয়
মোহাম্মদ সাদউদ্দিন : কলকাতার কলামিস্ট, প্রাবন্ধিক ও কবি
মতামত লেখকের নিজস্ব
আরও পড়ুন:
এবার বিহারের স্কুলে হিজাবে নিষেধাজ্ঞা!