শিক্ষাঙ্গনে রাজনীতির অপছায়া

এম এইচ রবিন
১৩ নভেম্বর ২০২৫, ০৮:০৪
শেয়ার :
শিক্ষাঙ্গনে রাজনীতির অপছায়া

রাজধানীর আকাশে এখনও আতঙ্কের ঘন মেঘ। রাস্তায় বিস্ফোরণের শব্দ, টহলরত বিজিবির গাড়ি, আর সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিও- সব মিলিয়ে শহরজুড়ে অজানা এক অস্থিরতা। সেই অস্থিরতার প্রথম থাবা এবার পড়েছে শিক্ষাঙ্গনে। নিরাপত্তার অজুহাতে ক্লাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, শুরু হচ্ছে অনলাইনে পাঠদান। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে- এটি কি কেবল নিরাপত্তাজনিত সিদ্ধান্ত, নাকি রাজনৈতিক প্রভাবের আরেক রূপ?

সাম্প্রতিক সময়ে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনগুলোর ঘোষিত ‘লকডাউন’ কর্মসূচিকে ঘিরে রাজধানীতে সংঘর্ষ, ককটেল বিস্ফোরণ ও নাশকতার ঘটনা বেড়েছে। এর প্রভাব পড়েছে সরাসরি বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে। ইস্ট ওয়েস্ট, ড্যাফোডিল, শান্ত-মারিয়াম, আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি-বাংলাদেশ (এআইইউবি), ইস্টার্ন, সোনারগাঁও ও নর্থ সাউথসহ অন্তত সাতটি বিশ্ববিদ্যালয় বুধবার ও বৃহস্পতিবারের (১২-১৩ নভেম্বর) সব সশরীরে ক্লাস ও পরীক্ষা স্থগিত করে অনলাইনে নেওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে।

এদিকে মোহাম্মদপুরের সেন্ট যোসেফ উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় অনলাইনে ক্লাস নেওয়ার সময়সূচিও ঘোষণা করা হয়েছে। নিউ ইস্কাটনের এজি চার্চ স্কুল নিরাপত্তাজনিত সমস্যার কথা উল্লেখ করে বৃহস্পতিবার স্কুল বন্ধ ঘোষণা করেছে। ইংরেজি মাধ্যম স্কুল সানিডেইল গতকাল ও বৃহস্পতিবার অনলাইনে ক্লাস নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। একই রকম সিদ্ধান্ত নিয়েছে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল স্কুল।

ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা এসএম মহিউদ্দিন বলেন, অনিবার্য কারণবশত সাময়িকভাবে সশরীরে ক্লাস স্থগিত করা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা বিবেচনাতেই অনলাইনে পাঠদান চলছে।

তবে শিক্ষার্থীদের একাংশ মনে করছে, নিরাপত্তার অজুহাতের আড়ালে শিক্ষাঙ্গনে ফের রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চলছে।

ইউজিসির পরামর্শ নেয়নি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো : বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) এ ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন বলেন, কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ই আমাদের সঙ্গে পরামর্শ করেনি। আশা করেছিলাম, তারা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সিদ্ধান্ত নেবে না। যদি তা হয়ে থাকে, সেটা দুঃখজনক। ইউজিসি বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছে।

শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ ও বিদ্রুপ : বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই ছিলেন গত জুলাইয়ের গণআন্দোলনের অগ্রভাগে। সেই আন্দোলনে অনেক শিক্ষার্থী নিহত, আহত ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়েছিলেন। এখন তারাই বলছেন- যারা সেই আন্দোলনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করেছিল, আজ তাদেরই ‘নিষিদ্ধ’ ঘোষিত দলের ডাকে ক্লাস বন্ধ রাখতে হচ্ছে- এটা এক ধরনের বিদ্রুপ।

নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী বলেন, যারা শেখ হাসিনার সরকারের পতনের লড়াইয়ে ছিল, তাদেরই এখন সেই আওয়ামী লীগের ‘লকডাউনের’ ভয়ে ঘরে বসে ক্লাস করতে বলা হচ্ছে- এটা কতটা বৈপরীত্যপূর্ণ! আরেক শিক্ষার্থীর ভাষায়, প্রতিবারই রাজনীতির আগুনে পুড়ে যাচ্ছে শিক্ষা। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় এখন যেন ক্ষমতার পালাবদলের বলি।

নর্থ সাউথের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন : সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শিক্ষার্থীদের তীব্র প্রতিক্রিয়া ও ইউজিসির অসন্তোষের পর নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় বুধবার দুপুরে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে। নতুন বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, বৃহস্পতিবার থেকে ক্লাস ও পরীক্ষা সশরীরে স্বাভাবিক সময়সূচি অনুযায়ী অনুষ্ঠিত হবে।

রাজনৈতিক ছায়া ও পুরনো নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ : মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সাবেক শিক্ষার্থী ও জুলাই আন্দোলনের অন্যতম নেতা রেজাউল করিম অভিযোগ করেন, দীর্ঘ ১৫ বছর আওয়ামী লীগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ট্রাস্টি বোর্ড নিজেদের লোক দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করেছে। এখনও অনেক বোর্ডে তাদের লোক বসে আছে। ফলে এই অনলাইন ক্লাস আসলে রাজনৈতিক কৌশল। তিনি বলেন, নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের নাশকতা ঠেকাতে আমরা ১৩ নভেম্বর বিভিন্ন পয়েন্টে অবস্থান নেব। কিন্তু অনলাইন ক্লাসের কারণে অনেক শিক্ষার্থীই অংশ নিতে পারবে না। এটা পরিকল্পিত বাধা।

অভিভাবকদের দ্বিধা ও শঙ্কা : রাজধানীর অভিভাবক সমাজেও মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। কেউ নিরাপত্তার স্বার্থে অনলাইন ক্লাসকে ‘যুক্তিসঙ্গত’ বলছেন, কেউ বা ভবিষ্যতের জন্য ভয় পাচ্ছেন।

মিরপুরের গৃহিণী সালমা রওশন বলেন, আমার ছেলে ইস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। প্রতিদিন যাতায়াত এখন ঝুঁকিপূর্ণ। অনলাইন ক্লাস আপাতত নিরাপদ মনে হচ্ছে। অন্যদিকে রামপুরার অভিভাবক কামাল হোসেনের মত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে রাজনীতির হাত থেকে মুক্ত রাখতে হবে। না হলে এই খড়্গ থেকে কেউ রক্ষা পাবে না।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সতর্ক অবস্থান : রাজনৈতিক অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণে রাখতে রাজধানীসহ আশপাশের জেলায় ১৪ প্লাটুন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) মোতায়েন করা হয়েছে। বিজিবির জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. শরীফুল ইসলাম জানান, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও জনগণের জানমালের নিরাপত্তায় বিজিবি মোতায়েন রয়েছে। তবে বুধবার রাজধানীর মিরপুর এলাকায় যানবাহনে অগ্নিসংযোগ, ককটেল বিস্ফোরণের খবর মিলেছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির একজন কর্মকর্তা বলেন, আমরা কোনো রাজনৈতিক চাপে সিদ্ধান্ত নিইনি। শুধু শিক্ষার্থী ও শিক্ষক নিরাপত্তার কারণে সাময়িকভাবে অনলাইনে ক্লাস নেওয়া হচ্ছে।

বাংলাদেশের ইতিহাসে রাজনৈতিক কর্মসূচি মানেই শিক্ষাঙ্গনের অচলাবস্থা, এমন উদাহরণ নতুন নয় বলে মনে করেন অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি মো. জিয়াউল কবির দুলু। তিনি বলেন, হরতাল, অবরোধ বা আন্দোলনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ছাত্রছাত্রীরাই।

গত দেড় দশকে অসংখ্য সেশনজট, পরীক্ষার বিলম্ব, ভর্তি ঝুঁকি আর মানসিক অস্থিরতার বোঝা বহন করতে হয়েছে তাদের। এবারও সেই পুরনো চিত্রই ফিরে আসছে বলে আশঙ্কা করছেন শিক্ষাবিদরা। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ বলেন, শিক্ষাঙ্গনে রাজনীতির খড়গের পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। তিনি বলেন, শিক্ষাঙ্গন বারবার রাজনৈতিক সংঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এটা শুধু শিক্ষার নয়, সমাজের জন্যও ভয়াবহ সংকেত। শিক্ষা রাজনীতির কবলে পড়লে জাতির ভবিষ্যৎ অন্ধকার।