গণতান্ত্রিক রাজনীতির পরিসরকে পুরনো ফ্যাসিবাদী সংস্কৃতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে -হাসনাত কাইয়ুম
হাসনাত কাইয়ুম গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম নেতা ও রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক এবং সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী। তিনি বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের প্রতিষ্ঠাকালীন সহসভাপতি এবং বাংলাদেশ লেখক শিবিরের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। হাসনাত কাইয়ুম রাষ্ট্র ও সংবিধান সংস্কার, জুলাই সনদ, সংঘাতমুখী রাজনীতি, গণভোট, জুলাই আন্দোলনে আহতদের সুচিকিৎসা, গণতান্ত্রিক উত্তরণ, নতুন রাজনৈতিক দলসহ নানা বিষয়ে আমাদের সময়ের সঙ্গে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রণজিৎ সরকার
সাক্ষাৎকার
আমাদের সময় : রাষ্ট্র সংস্কার নিয়ে আপনাদের দল প্রথম সংস্কারের দাবি তুলেছিল? রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের দল হিসেবে কী ধরনের প্রেরণা ও উদ্দেশ্য ছিল?
হাসনাত কাইয়ুম : আমরা মূলত এই আলাপটা আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু করি ২০১৩ সালে, ‘বাংলাদেশের সংবিধান পর্যালোচনা‘ প্রকাশের মধ্য দিয়ে। পরে ‘রাষ্ট্র চিন্তা’ থেকে রাষ্ট্র সংস্কারের ৭ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করা হয় এবং ২০২১ সালে আমরা এই ৭ দফা বাস্তবায়নের জন্য ‘রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন’ নামে রাজনৈতিক দল গঠন করি। রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন এবং অপরাপর ৬টি দল মিলে ‘গণতন্ত্র মঞ্চ’ গঠিত হয়, যারা সংস্কারের রাজনীতিকে অনেকাংশে গ্রহণ করে। বিএনপি এ পর্যায়ে মঞ্চের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলন গড়ে তোলার ভিত্তি হিসেবে মঞ্চসহ অপরাপর দলের সঙ্গে আলোচনা করে, রাষ্ট্র মেরামতের ৩১ দফা কর্মসূচি গ্রহণ করার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র সংস্কারের রাজনীতি জাতীয় রাজনীতিতে জায়গা করে নেয়। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ক্ষমতা কাঠামোর পরিবর্তন ছাড়া বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব নয়, এই উপলব্ধি থেকে আমরা সংস্কারের রাজনীতি শুরু করি।
আমাদের সময় : সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে চলমান যে সংকট তৈরি হয়েছে, এ বিষয়টি আপনি কীভাবে দেখছেন?
হাসনাত কাইয়ুম : বর্তমান সংকট অনেকটাই কয়েকটি বড় রাজনৈতিক দল এবং সরকারের ভেতরে থাকা কিছু মানুষের কৃত্রিমভাবে সৃষ্টি করা। এই দলগুলো পুরনো রাজনৈতিক মনস্তত্ত্ব অনুযায়ী নির্বাচনের আগে বিজয়ী হতে চায় এবং প্রায় মীমাংসিত বিষয়গুলো নিয়ে অকারণ সংকট সৃষ্টি করেছে। আশাকরি এ কৃত্রিম সংকট আমরা কাটিয়ে উঠতে পারব।
আমাদের সময় : জুলাই সনদের আইনি কোনো ভিত্তি হলো কি। সনদে স্বাক্ষর করা, না করা দলগুলো নিয়ে আপনি কীভাবে দেখছেন? এবং সনদের প্রভাব দেশের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় থাকবে বলে আপনি মনে করেন?
আরও পড়ুন:
সব প্রতীক্ষার সমাধান হবে?
হাসনাত কাইয়ুম : আমরা ফ্যাসিবাদবিরোধী প্রায় সব দলই সনদের আইনি ভিত্তি চেয়েছি। সনদে যারা স্বাক্ষর করেনি তারাও। তবে এর আইনগত পরিণতি যাই হোক, বাংলাদেশের রাজনীতিতে এর প্রভাব অবশ্যই থাকবে।
আমাদের সময় : নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশ কি এখন সংঘাতমুখী রাজনীতির দিকে যাচ্ছে?
হাসনাত কাইয়ুম : সেটাই তো দেখা যাচ্ছে। জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে ভিন্নমত, কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের পুরনো কায়দার কর্মসূচি পালন, আঙুল বাঁকা করার হুমকি, নিজেদের দলীয় মতামত বলপূর্বক জাতির ওপর চাপিয়ে দেওয়ার মানসিকতা, গণতান্ত্রিক রাজনীতির পরিসরকে পুরনো ফ্যাসিবাদী সংস্কৃতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে, এর পরিবর্তন না হলে সংঘাতের পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে।
আমাদের সময় : গণভোটের প্রয়োজনীয়তা আছে কি না, যদি সাধারণ নির্বাচন ও গণভোট একই দিনে অনুষ্ঠিত হয়, তাহলে এর সুবিধা-অসুবিধা কী হতে পারে?
হাসনাত কাইয়ুম : প্রয়োজনের চেয়ে বড় কথা, প্রায় সব রাজনৈতিক দল গণভোটের বিষয়ে একমত হয়েছে। এই মুহূর্তে জাতীয় নির্বাচনের রোডম্যাপ অনুযায়ী নির্বাচন করতে হলে আলাদা করে গণভোট করা প্রায় অসম্ভব। জাতীয় নির্বাচন এবং গণভোট একসঙ্গে করলে এর গুণাগুণ-মানের তেমন কোনো হেরফের হবে না। যারা গণভোট আগে করার পক্ষে, তারা জাতীয় নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশের আগে গণভোটের ফল প্রকাশের দাবি করতে পারে।
আমাদের সময় : জুলাই আন্দোলনে আহতদের সুচিকিৎসা, হতাহতদের ক্ষতিপূরণ এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা, এমনকি মানুষের দৈনন্দিন জরুরি প্রয়োজনগুলো মেটাতে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ব্যর্থ হয়েছে বলে মনে করেন কি?
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
হাসনাত কাইয়ুম : এই বিষয়গুলোতে সরকার পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে বলা যাবে না। তবে তাদের অদক্ষতা, আশানুরূপ ফলাফল পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করেছে। মানুষ দুর্ভোগের শিকার হয়েছে, শহীদ এবং আহতরা যথাযথ মর্যাদা এবং সেবা পায়নি, এটা তো স্পষ্টই।
আমাদের সময় : গণতন্ত্র মঞ্চ থেকে নির্বাচন নিয়ে আপনাদের পরিকল্পনা কী?
হাসনাত কাইয়ুম : আমরা আসন্ন এয়োদশ নির্বাচনকে দেশে ফ্যাসিবাদ মোকাবিলা, অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা তৈরি এবং আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করছি। সেজন্য আমরা ঘোষিত সময়ের মধ্যেই নির্বাচন চাইছি। কিন্তু এ নির্বাচনকে আমরা কেবল গতানুগতিক ক্ষমতা বদলের নির্বাচন হিসেবে দেখছি না। আমরা আমাদের শহীদ এবং আহতদের আকাক্সিক্ষত যে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, সেই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য সংবিধানের এবং রাষ্ট্র পরিচালনার আইনকানুন পরিবর্তনের জন্যও এই নির্বাচনকে কাজে লাগাতে চাই। আমরা সেই লক্ষ্যে মঞ্চগতভাবে এবং প্রয়োজনে অপরাপর দল ও জোটের সঙ্গে সমঝোতা করে নির্বাচনের সম্ভাবনাও বাদ দিচ্ছি না।
আমাদের সময় : এয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পথে বাংলাদেশ। নতুন রাজনৈতিক দলগুলো ভোটের মাঠে কেমন ভূমিকা রাখবে বলে মনে করেন?
হাসনাত কাইয়ুম : এ অঞ্চলের নির্বাচনের ইতিহাসে এবার একটা ব্যতিক্রমী এবং দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে। এর আগে যতবার রাজনৈতিক পরিবর্তনের জন্য বড় রাজনৈতিক আন্দোলনের ফলে নির্বাচন হয়েছে, ততবার আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী শক্তি বিপুল বিজয় অর্জন করেছে। ১৯৪৬, ১৯৫৪, ১৯৭০, ১৯৯০ এ রকম সবকটি নির্বাচন তার উদাহরণ। কিন্তু এবারই আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী তরুণরা তেমন কোনো অবস্থা তৈরি করতে পারেনি। বরং তারা বিভিন্নভাবে বিভিন্ন শক্তির অনুগামী হওয়ার দুঃখজনক বাস্তবতা তৈরি করেছে।
আমাদের সময় : গণতন্ত্র উত্তরণের জন্য বিচার, সংস্কার, নির্বাচন- এগুলো বাস্তবায়নে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রম আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করেন।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
হাসনাত কাইয়ুম : এই সরকার তো এসব বিষয়ে ওয়াকিবহাল ছিল না। দুর্ভাগ্যজনক হলো যারা তাদের প্রকৃত সহায়তা করতে পারত তাদের সহায়তাও তারা নেয়নি। তারা নিজেরা নিজেদের মতো এসব করতে গিয়ে মোমেন্টাম মিস করেছে, ভুল পদ্ধতি অনুসরণ করে জনগণের বিপুল অংশকে এই প্রক্রিয়ার বাইরে ফেলে দিয়েছে। এবং সবশেষে নিজেদের অভিমত চাপিয়ে দিতে গিয়ে জনগণকে বিভাজিত করে ফেলেছে। তবে আশার বিষয় হলো, সব আশা এখনও শেষ হয়ে যায়নি। দেশের মানুষের পরিবর্তনের যে আকাক্সক্ষা সেটাই সব ব্যর্থতার অবসান ঘটাবে এবং পরিবর্তনের সূচনা ঘটবে।
আমাদের সময় : সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
হাসনাত কাইয়ুম : ধন্যবাদ।