ব্যাংক ঋণের চাহিদা কমেছে সরকারের

জিয়াদুল ইসলাম
১১ নভেম্বর ২০২৫, ০৮:৩৪
শেয়ার :
ব্যাংক ঋণের চাহিদা কমেছে সরকারের

উন্নয়ন প্রকল্পের কাজে ধীরগতি ও রাজস্ব আয়ে প্রবৃদ্ধির কারণে ব্যাংক ঋণ নির্ভরতা কমিয়েছে সরকার। চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণ কমেছে প্রায় ৫০৩ কোটি টাকা। এ সময়ে শুধু কেন্দ্রীয় ব্যাংকই নয়, বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকেও সরকারের ঋণ কমেছে। অর্থাৎ, সরকারের আয়ের তুলনায় ব্যয় কম হওয়ায় ব্যাংক ঋণের প্রয়োজন কম পড়ছে। যদিও একই সময়ে নন-ব্যাংকিং উৎস্য থেকে সরকারে ঋণ বেড়েছে। অর্থনীতিবিদসহ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারের ঋণ কমা স্বল্পমেয়াদে ইতিবাচক হলেও উন্নয়ন ব্যয়ে ধীরগতি তথা বড় প্রকল্পগুলোর কাজ যদি দ্রুত অগ্রসর না হয়, তবে অর্থনীতি প্রত্যাশিত গতি পাবে না। বিশেষ করে অবকাঠামো, জ্বালানি ও যোগাযোগ খাতে ধীরগতি বেসরকারি বিনিয়োগকে প্রভাবিত করতে পারে।

প্রতি বছরই বড় অঙ্কের ঘাটতি রেখে বাজেট পেশ করে আসছে সরকার। এই ঘাটতি মেটানো হয় মূলত দুটি উৎস থেকে। অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক খাত। বৈদেশিক খাত থেকে প্রয়োজনীয় অর্থ সহায়তা পাওয়া না গেলে অভ্যন্তরীণ উৎসের ওপরই বেশি নির্ভর করতে হয় সরকারকে। অভ্যন্তরীণ উৎসের মধ্যে রয়েছে ব্যাংক ব্যবস্থা, নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বীমা কোম্পানি এবং সঞ্চয়পত্র খাত। চলতি অর্থবছরের বাজেটে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে নিট ১ লাখ ৪ হাজার কোটি টাকার ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার। এটি বাজেটে প্রক্ষেপিত মোট ঘাটতির প্রায় ৪৬ শতাংশ এবং গত অর্থবছরের সংশোধিত ব্যাংক ঋণের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা বেশি। এই ঋণের পুরোটাই বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে নেওয়া হবে। কারণ, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে গত অর্থবছরের আগস্টের পর থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া পুরোপুরি বন্ধ রেখেছে অন্তর্বর্তী সরকার।

জানা গেছে, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকে সরকারের উন্নয়নকাজে ধীরগতি চলছে। অনেক মন্ত্রণালয় ও বিভাগের প্রকল্প বাস্তবায়নের হার তলানিতে রয়েছে। চলতি অর্থবছরে ১ হাজার ১৯৮টি প্রকল্প চলমান রয়েছে। এর মধ্যে ১ হাজার ১৫টি বিনিয়োগ প্রকল্প। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) সর্বশেষ প্রতিবেদন বলছেÑ চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) বিভিন্ন প্রকল্পে খরচ হয়েছে মাত্র ১২ হাজার ১৫৮ কোটি টাকা, এটি এ খাতে মোট বরাদ্দ অর্থের মাত্র ৫.০৯ শতাংশ। এর মধ্যে সরকারি অর্থায়ন থেকে খরচ হয়েছে ৬ হাজার ৩০৭ কোটি টাকা, বিদেশি ঋণ থেকে খরচ হয়েছে ৫ হাজার ৭৪ কোটি টাকা, মন্ত্রণালয়গুলোর নিজস্ব অর্থায়ন হয়েছে ৭৭৭ কোটি টাকা। অন্যদিকে আলোচ্য তিন মাসে সরকারের রাজস্ব আয়ে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় রাজস্ব আদায় বেড়েছে ২০.৪৫ শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, সরকারের বাজেট ঘাটতি এখন নিয়ন্ত্রিত পর্যায়ে আছে। রাজস্ব প্রবাহ ভালো এবং ব্যয়ের চাপ সীমিত থাকায় সরকার ব্যাংক ঋণ কম নিচ্ছে। এতে সামগ্রিক মুদ্রানীতির ওপর ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন বলছে, গত অর্থবছরের ৩০ জুন শেষে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে সরকারের মোট ঋণের পুঞ্জীভূত স্থিতি ছিল ৫ লাখ ১৭ হাজার ৯৮৬ কোটি টাকা। এটি চলতি অর্থবছরের ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত কমে হয়েছে ৫ লাখ ১৫ হাজার ৪৪৫ কোটি টাকা। ফলে অর্থবছরের প্রথম চার মাসে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ার পরিমাণ কমেছে প্রায় ২ হাজার ৫৪০ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের একই সময়ে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে সরকারের নেওয়া ঋণের পরিমাণ ছিল ৫৫ হাজার ২১০ কোটি টাকা।

অন্যদিকে গত অর্থবছরের ৩০ জুন শেষে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নেওয়া সরকারের ঋণের স্থিতি ছিল ৯৮ হাজার ৪২৩ কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরের ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত কমে হয়েছে ৯৭ হাজার ৫২৪ কোটি টাকা। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এই চার মাসে সরকারের ঋণ কমেছে প্রায় ৮৯৯ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের প্রথম চার মাসে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সরকারে ঋণ কমেছিল প্রায় ৪০ হাজার ৬৮৩ কোটি টাকা।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ৩০ অক্টোবর শেষে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের নেওয়া নিট বাংক ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ৫০ হাজার ৪০১ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের ৩০ জুন শেষে সরকারের নিট ব্যাংক ঋণের স্থিতি ছিল ৫ লাখ ৫০ হাজার ৯০৪ কোটি টাকা। ফলে চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের নিট ঋণ কমেছে প্রায় ৫০৩ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের প্রথম চার মাসে ব্যাংক ব্যবস্থা থেবে সরকারের নিট ঋণ নেওয়ার পরিমাণ ছিল ১৫ হাজার ৪৫০ কোটি টাকা। তবে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের নিট ঋণ কমলেও ব্যাংক বহির্ভূত খাত (নন-ব্যাংক) থেকে বেড়েছে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত অর্থবছরের ৩০ জুন শেষে নন-ব্যাংকিং উৎস থেকে সরকারের ঋণের স্থিতি ছিল ১ লাখ ৪০ হাজার ৬১২ কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরের ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ৫০ হাজার ১৭৮ কোটি টাকা। ফলে চার মাসে নন-ব্যাংকিং খাত থেকে সরকারের নিট ঋণ বেড়েছে প্রায় ৯ হাজার ৫৬৫ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের প্রথম চার মাসে এই বৃদ্ধির পরিমাণ ছিল ১৬ হাজার ৯১৬ কোটি টাকা। সবমিলে অভ্যন্তরীণ উৎস্য থেকে চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (সঞ্চয়পত্র বাদে) সরকারের নিট ঋণ বেড়েছে ৯ হাজার ৬২ কোটি টাকা।