নিউইয়র্কের মামদানি এবং আমাদের মামদোভূতরা

আদনান আরিফ সালিম
১১ নভেম্বর ২০২৫, ০৭:৩৩
শেয়ার :
নিউইয়র্কের মামদানি এবং আমাদের মামদোভূতরা

ইতিহাস থেকে বর্তমান। ভারত, পাকিস্তান, ওপার বাংলা কিংবা বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রভাব আর ক্ষমতার ক্ষেত্রে একচ্ছত্র আধিপত্য বংশমর্যাদা, পারিবারিক পরিচয় আর উত্তরাধিকারের। বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেখানে জন্মসূত্রে বাংলাদেশি না হলে চাকরির আবেদনপত্র যাচাই-বাছাইয়ে ফেলে দেয়। সেখানে গেল সপ্তাহের মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্রে নিউইয়র্কের মতো শহরের মেয়র হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন জোহরান মামদানি। মা ও বাবার ধর্মীয় পরিচয়ের ভিন্নতা, তার বেড়ে ওঠা, সামাজিকীকরণ ও ব্যক্তিসত্তার বহুমুখিতা মিলিয়ে এই জয় ছিল এক আশ্চর্যকর রূপান্তরের স্বাক্ষর।

যুক্তরাষ্ট্রের কেউ হয়তো ভাবেনি এক তরুণ, যার বয়স মাত্র ৩৪ বছর। জানুয়ারি মাসের দিকে মাত্র এক শতাংশ ভোট নিয়ে নামমাত্র টিকে ছিলেন, তিনি নিউইয়র্ক জয় করবেন। তারপরও তিনি এলেন, দেখলেন আর জয় করলেন এক সময়ের প্রতাপশালী গভর্নর আঁদ্রে কুমোর বিরুদ্ধে। বলাই বাহুল্য ৬৭ বছর বয়সের পোড় খাওয়া এই রাজনীতিক একটি প্রতাপশালী রাজনৈতিক বংশের প্রতিনিধিত্বও করেন। ওদিকে তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন সামাজিকতাবাদী মনোভাবের এই নবাগত তরুণ, যিনি আবার জন্মসূত্রেও মার্কিনি নন। তার থেকেও অবাক বিষয় এই ঘটনাটি ঘটেছে নিউইয়র্ক এলাকায় অর্থাৎ আমেরিকার আর্থিক রাজধানী, বৃহত্তম ও প্রভাবশালী শহরে।

মামদানি যেখানে হেসেখেলে জিতে গিয়েছেন নিউইয়র্কে, আমাদের এখানে প্রতিটি পদে পদে দেখা মিলবে মামদো ভূতের যারা ‘মামদানিদের মতো’ কারও উত্থান রুখে দিতে নিরলস শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন। তাদের কাছে কাজের তুলনায় আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, ফাইল নোটের মারপ্যাঁচ আর এলোমেলো নানা বিধিবিধান অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আর দেশের জটিল থেকে জটিলতর হয়ে ওঠা আইন ও বিধি তাদের এই অপকর্মের সুযোগকে আরও প্রসারিত করছে। বিপরীতে প্রলম্বিত হচ্ছে জনদুর্ভোগ।

বংশগত পরিচয়ের বাইরে থেকে বাংলাদেশে কিংবা ভারত উপমহাদেশের কোনো দেশে যেখানে রাজনীতিতে মনোনয়ন জোগাড় করা কঠিন, সেখানে মামদানির চোখজুড়ানো জয় এক বিরল দৃষ্টান্ত হিসেবে জাতীয় খবর হয়ে উঠেছে দক্ষিণ এশিয়ায়ও। এই ঘটনা যেমন আরও অনেক আমেরিকানকে প্রেরণা দেবে সামাজিকতাবাদী চিন্তার দিকে মনোযোগ দেওয়ার জন্য, তেমনি আমাদের দেশেও তার থেকে শেখার রয়েছে অনেক কিছু।

যদিও অনেক ডেমোক্র্যাটিক পার্টির ভোটার এখন তাদের দল নিয়ে বিরক্ত। তারা দলকে দেখছেন বড় ব্যবসা-বিত্তের স্বার্থে কাজ করতে। মধ্যবিত্তের গড়বান্ধব জীবনের কথা বলতে গিয়ে তারা কিন্তু সাধারণ মানুষের কথা বলছে না। তারা খুঁজছেন এমন কোনো রাজনৈতিক আন্দোলন, যেখানে স্পষ্ট দৃষ্টি এবং শাসক-সংস্থার বিরুদ্ধে উন্মুক্ত মনোভাব থাকবে। তারা চাইছেন এমন একটি পরিকল্পনা যা বাস্তবে কাজ করবে জনসাধারণের জন্য। এই মুহূর্তে মামদানিরা যেই ধারায় এগিয়ে চলেছেন সেখানেই সেই সম্ভাবনার পথ উন্মুক্ত।

ডেমোক্রেটিক সোশ্যালিজম শব্দটি আমাদের জন্য পুরোপুরি নতুন। ভাস্কর সুনকারা যখন জ্যাকবিন ম্যাগাজিনের সহপ্রতিষ্ঠাতা হিসেবে এই শব্দ নিয়ে প্রথম আলোড়ন তুললেন অনেকেই সেটা নিয়ে হা হা হিহি করেছিল। কেউ কেউ ভেবেছিল তার ‘The Socialist Manifesto’ গ্রন্থের বেশির ভাগ চিন্তাই ইউটোপিয়া। তবে তিনি শক্তপোক্তভাবে বলেছেন এবং লিখেছেন। তার হিসেবে ‘অনেক তরুণ যারা এই লেবেল ব্যবহার করছেন, তারা মূলত মূলধারার পুঁজিবাদের ভেতরেই সামাজিক প্রকল্প চাইছেন। তারা চান রাষ্ট্র হোক বাসস্থান সস্তা করার জন্য, রাষ্ট্র হোক সাধারণ স্বাস্থ্যবীমা প্রদান করার জন্য, তারা চান সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থার প্ল্যাটফর্ম, যাতে দারিদ্র্য ও শ্রমজীবী মানুষের জীবন একটু ভালো হয়।’ কার্ল মার্কসের তত্ত্বচিন্তা কিংবা লেনিন ও হবসনের বড় বড় লাল বই বগলে নিয়ে দৌড়াদৌড়ি না করে তাদের চিন্তাটা অনেকাংশেই জীবনমুখী। এজন্য মানুষও হুট করে তাদের গ্রহণ করেছেন।

ভাস্কর সুনকারা শুরুতেই ভেবেছিলেন এই পদ্ধতি কীভাবে জনপ্রিয়। তিনি কোনো ভণিতা না করে লিখেছিলেন, ‘আমার মতে, সামাজিকতাবাদ শুধু কল্যাণ বা আশাবাদ বিতরণের বিষয় নয়, এটি ক্ষমতা ও মালিকানার প্রশ্নকেও সামনে আনে। শুধু রাজনৈতিক গণতন্ত্র নয়, আমাদের উচিত সেই সমাজ যেখানে কর্মক্ষেত্রেও গণতন্ত্র থাকবে।’ আর সম্প্রতি মামদানির মেয়র প্রার্থিতার কাজকর্মে এই দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট দেখা গেছে। আর তিনি জিতে এসেছেন।

মামদানি শুরু থেকেই বলছেন, ‘উচ্চ আয়ের ব্যক্তিদের ওপর কর বাড়াতে হবে, ভাড়া স্থির তথা রেন্ট ফ্রিজ করা হবে, প্রচুর পরিমাণে সস্তা বাসস্থান নির্মাণ করা হবে, বিনামূল্যে বাস চালু করা হবে, সরকারি সহযোগিতায় সবার জন্য কেনাকাটার সুযোগ হয় এমন মুদি দোকান টাইপের ডিপার্টমেন্টাল স্টোর খোলা হবে। তিনি দেখাতে চেয়েছেন মানুষের জীবনকে ঝামেলাপূর্ণ না করে সহজ করে তোলার মূলমন্ত্র। আর অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ভেঙে নতুন করে বিপ্লব ঘটানোর মতো কিছু না বলেও তিনি ব্যালটেই বিপ্লব করে বসে আছেন।

জোহরান মামদানির মূল ভাবনাতে যে ডেমোক্রেটিক সোশ্যালিজম তা নিউইয়র্কের মানুষের জীনযাত্রাকে সাবলীল করার স্বপ্ন দেখিয়েছে। তিনি মূলধারার পুঁজিবাদী অর্থনীতির ভেতরেই সামাজিক প্রকল্পের প্রয়োগ করে জনমত পক্ষে টেনেছেন। তবে এখানকার গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে সরকারি সম্পূর্ণ অর্থনীতিকে দখল না করেও সেই অর্থনীতির সঙ্গে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি যুক্ত করা। এখানে স্ক্যান্ডিনেভীয় ধরনের সামাজিক-উন্নত জীবনযাত্রার মডেলের দিকে চোখ রাখতে দেখা গেছে। তিনি সংস্কারবাদী ডেমোক্র্যাটদের থেকে অনেক বেশি সুস্পষ্ট বিরোধী মনোভাব সামনে নিয়ে কাজ করেছেন। ফলে মূলধারার ডেমোক্র্যাটরা সাধারণত বড় ব্যবসার সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতে গিয়ে যে হেলদোল সৃষ্টি করেছেন তার থেকে এই ধারা ভিন্ন।

বাংলাদেশের বাস্তবতায় শ্রমজীবী-শ্রেণিকে কেন্দ্র করে কাজ করে এমন রাজনৈতিক পরিকাঠামো জরুরি। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) তাদের রাজনৈতিক প্রচারণা থেকে শুরু করে আসন্ন নির্বাচন সামনে রেখে যে ৩১ দফা নিয়ে কাজ করছে সেখানে এই ডেমোক্রেটিক সোশ্যালিজমের ছাপ রয়েছে। তারাও পুঁজি-শক্তিকে তাদের স্বার্থের বিপরীত হিসেবে চিহ্নিত করে জনমত ও জনজীবনের উন্নয়নকে গুরুত্ব দিচ্ছে। সম্প্রতি বিএনপির ৩১ দফা যেভাবে মধ্যবিত্তের গড় জীবনবোধকে সম্মান জানিয়ে কথা বলছে সাধারণ মানুষ যদি সেটিকে গ্রহণ করে তবে অনেক সমস্যার সমাধান হতে পারে। কিন্তু সাধারণ মানুষের জীবনের গভীর বৈষম্য নিয়ে সমস্যার তল পর্যন্ত পৌঁছানো যাচ্ছে কি না সেটাও বড় প্রশ্ন হয়ে থাকবে। আর সেই জায়গায় সবাই তাদের জন্য সমস্যাকে আরও গভীর করেই দেখাবে। তাই সমাধানও গভীর হতে হবে বলে বিশ্লেষকরা চিৎকার করে যাচ্ছেন।

কথা আর কাজের মিল রাখা রাজনীতিতে বড় চ্যালেজ্ঞ। সেটা আমেরিকা কিংবা বাংলাদেশ সবখানেই সমানভাবে প্রঙোজ্য। প্রিয় পাঠক, আপনাদের সেই Affordable Care Act (Obamacare) নামে মার্কিন আইনে কথা মনে থাকার কথা। সেখানে অনেক মানুষকে বীমায় আনা হয়েছিল, কিন্তু আজও লাখ লাখ মানুষ স্বাস্থ্যবীমা ছাড়া রয়ে গেছে। তাদের লাখের বেশি মানুষ চিকিৎসা সম্পর্কিত ঋণের ভারে জর্জরিত। ফলে তার সুফল কতটা পেয়েছে সাধারণ মানুষ তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক। ঠিক এর বিপরীতে গিয়ে বাজারভিত্তিক ‘লোয়ারেডি’ যথেষ্ট নয়। উদাহরণস্বরূপ, Medicare for All Act যেমন একটি কঠিন এবং স্থায়ী সমাধান হতে পারত, তেমনি Medicare বা Social Security হয়ে গেছে অনেকের জন্য হাসির খোরাক।

সমাজতন্ত্র কিংবা গণতন্ত্র নিয়ে ‘সাময়িক উত্তেজনা’ আছে এমন বিষয় নয় গণমুখী প্রচারণা আর তার বাস্তবায়ন মামদানিকে প্রচারাভিযানে অনন্য করেছিল। সেখানে সেই উত্তেজনা যেমন ছিল, তেমনি তিনি অগণিত ভলান্টিয়ার সংগঠিত এক শক্তিও তৈরি করেছিলেন। বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি কতটা জনমুখী হতে পারে আর সেটা কীভাবে জনগণের সামনে তুলে ধরতে পারে সেটাই দেখার বিষয়। কারণ মানুষ অনুভব করছে এখন শুধুই অপেক্ষা নয়, সময়ের প্রয়োজনে জনগণকেই শক্তিতে পরিণত করতে কারা অগ্রগামী? সেটা দেখতে। কারা তাদের পক্ষে এলিট-স্বার্থের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারবে? আর ব্যালট হাতে নিয়ে সিলটা তাদের প্রতীকে দিতেই জনগণ প্রস্তুত। তাই নিউইয়র্কের নির্বাচনে জোহরান মামদানির এই জয় নিয়ে আমাদের দেশের ফাইল আঁকড়ে থাকা মামদোভূতরাও ভাবছে। তাদের সব রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে জনগণের ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনার চ্যালেঞ্জ এখন রাজনৈতিক দলগুলোর সামনে। তারা এই কাজে কতটুকু সফল হবে তার ওপর বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ যেমন নির্ভর করছে, তেমনি তাদের ভবিষ্যৎও এর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।


ড. মো. আদনান আরিফ সালিম : গবেষক ও কন্টেন্ট ক্রিয়েটর, সহযোগী অধ্যাপক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

মতামত লেখকের নিজস্ব