বার্ষিক পরীক্ষার আগে অচল পাঠদান, বাড়ছে উদ্বেগ
বেতন-ভাতা ও পদোন্নতির দাবিতে দেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকরা অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতি শুরু করেছেন। গতকাল রবিবার সকাল থেকে শুরু হওয়া এই কর্মবিরতির ফলে সারা দেশের ৬৫ হাজারের বেশি বিদ্যালয়ে পাঠদান বন্ধ হয়ে যায়। শিক্ষকদের অভিযোগ, দীর্ঘদিন ধরেই তাঁদের দাবি উপেক্ষিত হচ্ছে। অন্যদিকে সরকার বলছেÑ সহকারী শিক্ষকদের দশম গ্রেড দাবি বাস্তবসম্মত নয়, তবে ১১তম গ্রেডে উন্নীত করার প্রক্রিয়া এগোচ্ছে। এদিকে পুলিশের সাম্প্রতিক লাঠিচার্জে আহত সহকর্মীদের দেখে ক্ষুব্ধ শিক্ষক সমাজ আন্দোলন আরও তীব্র করেছে। অভিভাবক সংগঠনগুলো বলছে, শিশুশিক্ষা স্থবির হয়ে পড়ছে এবং সব পক্ষের সমঝোতা জরুরি।
গত শনিবার শাহবাগে ‘কলম বিসর্জন’ কর্মসূচির সময় পুলিশের লাঠিচার্জ, জলকামান ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপে শতাধিক শিক্ষক আহত হন, আটক হন পাঁচজন। এর পরই শিক্ষকরা ঘোষণা দেনÑ দাবি না মানা পর্যন্ত শ্রেণিকক্ষে ফিরবেন না। প্রাথমিক শিক্ষক দাবি বাস্তবায়ন পরিষদের
অন্যতম নেতা এবং বাংলাদেশ প্রাথমিক বিদ্যালয় সহকারী শিক্ষক সমিতির সভাপতি মো. শামছুদ্দিন মাসুদ বলেন, আমাদের ওপর হামলা হয়েছে অত্যন্ত অমানবিকভাবে। কেউ রক্তাক্ত, কেউ হাসপাতালে, কেউ আটক। আমরা রাস্তায় থেকেও দেশের ভবিষ্যৎ গড়তে চাই, কিন্তু সম্মানবোধ বিসর্জন দিয়ে নয়। তিনি জানান, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অবস্থান কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে এবং প্রয়োজনে বিদ্যালয়ে তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হবে।
আন্দোলনের পটভূমি
চলতি বছর এটি প্রাথমিক শিক্ষকদের দ্বিতীয় দফা কর্মবিরতি। মে মাসেও তাঁরা একই দাবিতে আন্দোলনে নামেন। তখন সরকারের আশ্বাসে ক্লাসে ফিরলেও প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে।
শিক্ষক নেতা আবুল কাশেম বলেন, দশম গ্রেড দাবি আমরা দীর্ঘদিন ধরে জানিয়ে আসছি। পরে ১১তম গ্রেডে আসতেও রাজি হয়েছিলাম, কিন্তু তাও বাস্তবায়ন হয়নি। এখন নতুন পে-কমিশনের কাছেও আবেদন দিয়েছি, সাড়া মেলেনি।
অভিভাবকদের উদ্বেগ
অভিভাবক ঐক্য ফোরাম জানিয়েছে, পাঠদান বন্ধ থাকায় শিশুদের শিক্ষা ক্ষতির মুখে পড়ছে। সংগঠনের সভাপতি মো. জিয়াউল কবির দুলু জানান, ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে তৃতীয় প্রান্তিক শুরু হওয়ার কথা, অথচ তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণির পাঠ্যসূচির মাত্র ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশ শেষ হয়েছে। বিশেষ করে ইংরেজি ও গণিতে অগ্রগতি সীমিত থেকে গেছে ৫০-৫৫ শতাংশে। হাতে আছে কেবল ২০-২৩ কর্মদিবস, যা দিয়ে সম্পূর্ণ পাঠ শেষ করা প্রায় অসম্ভব। তাঁদের মতে, সংকটের দায় শিক্ষক, প্রশাসন এবং কর্তৃপক্ষÑ সবারই। অসম্পূর্ণ পাঠ্যসূচি নিয়ে পরীক্ষার ব্যবস্থা করা যাবে না।
অভিভাবক ঐক্য ফোরাম সরকারের সংশ্লিষ্ট মহল ও শিক্ষক সমাজ উভয়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে- শিক্ষার্থীদের স্বার্থকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে দ্রুত আলোচনার মাধ্যমে স্থায়ী ও ইতিবাচক সমাধান বের করতে, যেন কোনো শিশুর শিক্ষাজীবন আন্দোলনের বলি না হয়।
সরকারের অবস্থান
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার বলেন, সহকারী শিক্ষকদের দশম গ্রেড দাবি যৌক্তিক নয়। প্রধান শিক্ষকরা মাত্রই দশম গ্রেড পেয়েছেন। সহকারী শিক্ষকদের সবাইকে একসঙ্গে ১৩ থেকে ১০ম গ্রেডে উন্নীত করা বাস্তবসম্মত নয়। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবু নূর মো. শামসুজ্জামান জানান, সহকারী শিক্ষকদের ১১তম গ্রেডে উন্নীত করার সুপারিশ করা হয়েছে, অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পেলেই তা কার্যকর হবে।
আরও পড়ুন:
একে আবদুল মোমেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী
শিক্ষক নির্যাতনের নিন্দা ও সংহতি
শিক্ষকদের ওপর পুলিশি হামলার ঘটনায় প্রধান শিক্ষক সমিতি, পিটিআই কর্মকর্তা সমিতি এবং সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার অ্যাসোসিয়েশন পৃথক বিবৃতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তারা হামলাকারী পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ও আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছে। পিটিআই কর্মকর্তা সমিতি জানায়, যারা দেশের প্রাথমিক শিক্ষার মান উন্নয়নে মূল ভূমিকা রাখছেন, তাঁদের ওপর হামলা দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ওপর আঘাত।
বৈষম্যের অভিযোগ
শিক্ষকরা বলেছেন, প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের (পিটিআই) পরীক্ষণ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকরা ১০ম গ্রেড পান, অথচ সাধারণ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকরা পান ১৩তম গ্রেড। একই যোগ্যতা ও দায়িত্বে এত বৈষম্য কেনÑ এ প্রশ্ন তুলেছেন তাঁরা। তাঁদের অভিযোগ, পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর, নার্স, ইউনিয়ন সচিবসহ অনেক পেশাজীবী একই স্তরে ১০ম গ্রেডে রয়েছেন, অথচ উচ্চ ডিগ্রিধারী শিক্ষকরা সেই মর্যাদা পান না।
উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা
গত শনিবার রাতে শহীদ মিনারে মোমবাতি প্রজ্বালন করে আহত সহকর্মীদের স্মরণ করেন শিক্ষকরা। তাঁরা স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ও প্রাথমিক শিক্ষা উপদেষ্টার পদত্যাগও দাবি করেন। আটক পাঁচ শিক্ষককে মুক্তি দেওয়া হলেও আন্দোলন থামেনি। আহত নেত্রী খায়রুন নাহার লিপি হুইলচেয়ারে বসেই অবস্থান কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে আন্দোলনের প্রতীকে পরিণত হয়েছেন।
শিক্ষকদের দাবির যুক্তি আর সরকারের সীমাবদ্ধতার টানাপড়েনে এখন স্থবির দেশের প্রাথমিক শিক্ষা। বার্ষিক পরীক্ষা ঘনিয়ে এসেছে, কিন্তু শ্রেণিকক্ষ নিস্তব্ধ। শিক্ষকদের হাতে কলম নয়Ñ জ্বলছে মোমবাতি, আর অভিভাবক-শিক্ষার্থীরা তাকিয়ে আছে একটাই প্রশ্নেÑ কবে শেষ হবে এই অচলাবস্থা?