শিক্ষকের মর্যাদাহীনতা: জাতির আত্মহননের নামান্তর

মাহবুবুর রহমান
১০ নভেম্বর ২০২৫, ০৭:৪৬
শেয়ার :
শিক্ষকের মর্যাদাহীনতা: জাতির আত্মহননের নামান্তর

সমাজের ভিত্তিপ্রস্তর যখনই অবহেলিত হয়, তখনই ধসে পড়ে সভ্যতার স্তম্ভ। বাংলাদেশে শিক্ষকদের প্রতি আমাদের সামষ্টিক অবহেলা ও মর্যাদাহীনতা কোনো সাধারণ ভুল নয়, বরং এটি এক গভীর জাতীয় সংকটের ইঙ্গিত। যাদের হাতে গড়ে উঠছে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম, তাদেরই আমরা সর্বাধিক উপেক্ষিত রেখেছি এক বিকৃত সামাজিক চুক্তির আওতায়।

বাংলাদেশে শিক্ষকদের বেতন নিয়ে আমাদের সমাজে এক ধরনের অদ্ভুত আত্মতুষ্টি বিরাজ করে- যেন শিক্ষকরা গরিব বলেই তাদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশ করা যায়! আমরা যেন এক অঘোষিত সামাজিক চুক্তিতে তাকে বেঁধে ফেলেছি। শিক্ষক মানেই ত্যাগী, বিনয়ী, আর্থিকভাবে অসচ্ছল- এ হলেই তিনি ‘আদর্শ’। কেউ যদি একটু ভালোভাবে বাঁচতে চান, তবে তাকে সন্দেহের চোখে দেখা হয়। আরও ভয়ংকর হলো, এই দৃষ্টিভঙ্গি এখন যুক্তির রূপ নিচ্ছে। কেউ কেউ গর্ব ভরে বলেন, ‘আমাদের শিক্ষকরা তো খুব একটা যোগ্য নন, তাই তারা যে বেতন পান, তা-ই ন্যায্য।’ কেউ আবার সান্ত্বনা দেন- ‘বেতন কম হলেও শিক্ষকরা তো কোচিং আর প্রাইভেট টিউশন করে আয় করেন!’

ড্রয়িংরুমের আলাপে, টকশোতে বা সামাজিক মাধ্যমের বিতর্কে- যেখানেই এই কথাগুলো উচ্চারিত হোক না কেন, এগুলো আসলে নিরীহ মন্তব্য নয়; বরং সমাজে শিক্ষার মর্যাদাবোধের কাঠামোগত সংকটের প্রতিফলন। এটি এমন এক মানসিকতা, যা আমাদের সমাজকে ধীরে ধীরে বুদ্ধিবৃত্তিক দারিদ্র্যের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আমরা বুঝতে পারি না, যখন শিক্ষক অবমূল্যায়িত হন, তখন তার প্রতিধ্বনি কেবল শ্রেণিকক্ষেই নয়, প্রতিটি নাগরিকের চরিত্র ও বিবেকে পৌঁছে যায়। রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ তখনই অন্ধকার হয়ে ওঠে, যখন শিক্ষককে সম্মানের বদলে নির্ভরশীলতার প্রতীকে পরিণত করা হয়।

এশিয়ার প্রথম সারির দেশগুলোর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ন্যূনতম বেতনের সাম্প্রতিক তুলনাই শিক্ষকদের প্রতি আমাদের অবহেলার বাস্তব চিত্র স্পষ্ট করে। উদাহরণস্বরূপ, সিঙ্গাপুরে একজন মাধ্যমিক শিক্ষক মাসে প্রায় সাড়ে ছয় লাখ টাকা আয় করেন। এটা ঠিক যে সিঙ্গাপুর এশিয়ার অন্যতম ব্যয়বহুল দেশ, কিন্তু জীবনযাত্রার খরচ বাদ দেওয়ার পরও এই আয় একজন শিক্ষককে মর্যাদাপূর্ণ জীবনের নিশ্চয়তা দেয়। চীনে গড়ে একজন শিক্ষকের মাসিক আয় প্রায় দুই লাখ বিশ হাজার টাকা, যা বাংলাদেশের চেয়ে অন্তত দশগুণের বেশি, যদিও চীনের জীবনযাত্রার খরচ আমাদের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ।

স্পষ্টতই দেখা যায়- যে দেশ শিক্ষককে মর্যাদা দেয়, সেই দেশই জ্ঞান ও উন্নয়নে এগিয়ে যায়। চীনে শিক্ষকতা একটি প্রতিযোগিতামূলক ও সম্মানজনক পেশা। ফলে সেখানে গড়ে উঠেছে সুশৃঙ্খল, আত্মবিশ্বাসী এবং বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে পরিপক্ব সমাজ- যেখানে শিক্ষক কেবল পাঠদানকারী নন, বরং জাতির চিন্তার স্থপতি।

এর বিপরীতে, দক্ষিণ এশিয়ায় শিক্ষকের মর্যাদা ও বেতন- দুই ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের অবস্থান প্রায় তলানিতে। এটি নিছক কাকতালীয় নয়; বরং রাষ্ট্রীয় অবহেলার ফল।

বাংলাদেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক এখনও তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী হিসেবে গণ্য হন। অথচ শিক্ষা অফিসের কম্পিউটার অপারেটর ১৬তম গ্রেড থেকে শুরু করে ধাপে ধাপে ১০ম গ্রেডে উন্নীত হন। দুঃখজনকভাবে শিক্ষকরা ১৩তম গ্রেডে চাকরি শুরু করেও সেই উন্নতির সুযোগ পান না। এটি প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর সঙ্গে নামমাত্র বেতন যুক্ত হয়ে পরিস্থিতিকে আরও বেদনাদায়ক করে তুলেছে। এটি যেন এমন এক কাঠামো, যেখানে শিক্ষককে শ্রদ্ধার আসন থেকে নামিয়ে আনুগত্যের স্থানে বসানো হয়েছে।

বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা যেসব মামুলি দাবি তোলেন, যেমন- মূল বেতনের কমপক্ষে ২০% বাড়িভাড়ার দাবি- তা দেখে মনে হয় তারা বড় কিছু ভাবার সাহসই হারিয়ে ফেলেছেন। সরকার সে দাবিও গুরুত্বসহকারে বিবেচনা না করায় তাদের আন্দোলন করতে হয়। পরে সরকার ধীরে ধীরে ৫% থেকে চলতি বছরে ৭.৫% এবং আগামী বছর জুন মাস থেকে ১৫% পর্যন্ত বৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু এই হিসাব কাগজে যতই সঠিক মনে হোক, এর মধ্যে নিহিত বার্তাটি স্পষ্ট- যারা ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তৈরি করেন, তাদের মূল্য এখনও ড্রাইভার থেকে শুরু করে আমলাতন্ত্রের সর্বোচ্চ কর্তাব্যক্তিদের নিচে।

অনেকে বলেন, ‘বেতন বাড়ালেই কি সমস্যার সমাধান হবে?’ উত্তর হচ্ছে- অবশ্যই হবে, তবে তা কাঠামোগতভাবে করতে হবে। আকর্ষণীয় বেতন পেশাটিকে মর্যাদাপূর্ণ করে তোলে; একই সঙ্গে নিয়োগে যোগ্যতার প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করে। উদাহরণস্বরূপ, ভিয়েতনাম শিক্ষক বেতন কাঠামোতে পারফরম্যান্স বোনাস যুক্ত করে মেধাবী তরুণদের শিক্ষকতায় আকৃষ্ট করেছে। ফলে সেখানে শ্রেণিকক্ষের মান ও জন-আস্থা- দুটিই বেড়েছে।

বাংলাদেশে শিক্ষকতার বর্তমান বেতন এমন যে মেধাবীরা এই পেশা এড়িয়ে চলেন। যারা আসেন, অনেকেই আসেন অনন্যোপায় হয়ে এবং কোচিংনির্ভর আয় দিয়ে টিকে থাকেন। এর ফলে শিক্ষা ধীরে ধীরে পণ্যে পরিণত হয়েছে- যেখানে জ্ঞান নয়, টাকার বিনিময়ে নম্বরই হয়ে উঠেছে লক্ষ্য।

অথচ আমরা সন্তানদের প্রাইভেট টিউশন বা বিদেশে পড়াশোনার জন্য লাখ লাখ টাকা ব্যয় করি, কিন্তু শিক্ষকের বেতন বাড়ানোর প্রস্তাব এলে তীব্র আপত্তি তুলি। এই বৈপরীত্যই আমাদের সাংস্কৃতিক সংকটের প্রতিচ্ছবি। আমাদের ধারণা, প্রকৃত শিক্ষক হতে হলে দরিদ্র ও আত্মত্যাগী হতে হবে- যেন সচ্ছলতা শিক্ষকতার নৈতিকতাকে নষ্ট করে দেয়। ইতিহাস বলে, যেসব জাতি শিক্ষকদের মর্যাদা দিয়েছে, তারাই সভ্যতা ও উন্নতির নেতৃত্ব দিয়েছে। শিক্ষকদের সম্মান ও পারিশ্রমিক কোনো প্রশাসনিক বিষয় নয়, এটি জাতির অস্তিত্বের প্রশ্ন।

শিক্ষকদের মর্যাদা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত না হলে শত প্রশিক্ষণ কর্মশালা, ‘নতুন শিক্ষা প্রকল্প’ বা দাতাদের অর্থায়নে সংস্কার- কোনোটিই ফলপ্রসূ হবে না। ইউনেস্কোর সুপারিশ অনুযায়ী, প্রতিটি দেশের উচিত মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অন্তত ৫.৫ শতাংশ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ রাখা, যেখানে গবেষণা ও উদ্ভাবনের জন্য আলাদা তহবিল থাকবে। কারণ শিক্ষা ও গবেষণা অবিচ্ছেদ্য- শিকড় ও পাতার মতো, একটির অনুপস্থিতিতে অন্যটি টিকে থাকতে পারে না। বাংলাদেশে এই বরাদ্দ এখনও প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় অনেক কম। ফলে প্রকৃত বিনিয়োগ না হয়ে শিক্ষা খাত রয়ে গেছে প্রশাসনিক ব্যয় ও ইট-সিমেন্টনির্ভর। ফলাফল আমরা প্রতিদিন দেখছি- একটি ক্লান্ত শিক্ষক সমাজ, একটি কোচিংনির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা এবং একটি প্রজন্ম, যারা জ্ঞানের বদলে কেবল গ্রেডের পেছনে ছুটছে। আমরা যদি সত্যিই জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়তে চাই, তবে শিক্ষকের মর্যাদা ফিরিয়ে আনা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।


মো. মাহবুবুর রহমান : সহকারী অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ফরিদপুর সিটি কলেজ

মতামত লেখকের নিজস্ব