পোশাক কর্মীদের নিরাপত্তা: কতটা নিরাপদ শ্রমিকের জীবন
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত আজ বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ শিল্প। দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি এই খাত। যেখানে লাখো নারী-পুরুষ প্রতিদিন শ্রম দিচ্ছেন- কখনও কারখানার ভেতরের তীব্র গরমে, কখনও মেশিনের শব্দের ভেতর দিন-রাত পার করে। কিন্তু এই শ্রমের পেছনে যে জীবন, যে মানুষ- তাদের নিরাপত্তা ও মর্যাদা কতটা নিশ্চিত, সেই প্রশ্ন আবারও সামনে এসেছে নারায়ণগঞ্জের এক মর্মান্তিক ঘটনায়।
নারায়ণগঞ্জের বন্দরের মদনপুর এলাকায় লারিস ফ্যাশনের সুইং সেকশনে মেশিন অপারেটর হিসেবে কাজ করতেন রিনা (৩০)। তিনি কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়ার দুলাল হোসেনের মেয়ে। প্রতিদিন দীর্ঘ সময় ধরে সেলাই মেশিনের পাশে বসে কাজ করতে হতো তাকে। অভিযোগ আছে রবিবার সকালে তিনি অসুস্থ বোধ করেন এবং ছুটি চাইলে কর্তৃপক্ষ তাকে কাজ চালিয়ে যেতে বলে। সহকর্মীদের ভাষায়, তাকে বলা হয়- ‘নাটক করো না।’ কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি কর্মস্থলে অজ্ঞান হয়ে পড়েন। তখনও তাকে কর্তৃপক্ষ হাসপাতালে নেয়নি। প্রায় দুই ঘণ্টা পর সহকর্মীরা তাকে স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে যান, পরবর্তীতে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে নেওয়া হলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
পরের দিন সকালে সহকর্মী শ্রমিকরা বিক্ষোভে নামেন। এতে চট্টগ্রামমুখী লেনে প্রায় কয়েক কিলোমিটার এলাকায় যানজটের সৃষ্টি হয়। ভোগান্তিতে পড়ে যাত্রীরা। ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে বন্দর থানার ওসি লিয়াকত আলী বলেন, অসুস্থ হয়ে নারী শ্রমিকের মৃত্যুর পর সহকর্মী শ্রমিকরা প্রায় দুই ঘণ্টা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করে রাখেন। মহাসড়ক অবরোধের কারণ হিসেবে পুলিশকে তাদের অভিযোগ জানান। তাদের মতে, কারখানা কর্তৃপক্ষের অবহেলায় ওই শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। তাদের দাবি- ‘অসুস্থ অবস্থায়ও কাজ করাতে গিয়ে রিনার মৃত্যু হয়েছে, তার দায় নিতে হবে কর্তৃপক্ষকে।’ পরে অবশ্য পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিলে শ্রমিকরা অবরোধ তুলে নেন। এরপর যান চলাচল স্বাভাবিক হয়। লারিস ফ্যাশনের প্রধান নির্বাহী মোহাম্মদ শিমুল অবশ্য ভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তার দাবি, ‘আমরা তাৎক্ষণিকভাবে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছি, কোনো গাফিলতি ছিল না। মৃত্যুর পরও পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছি এবং সব রকম সহযোগিতা করেছি। মৃত্যুর পর দাফনসহ পরিবারের সহায়তার ব্যবস্থাও নিয়েছি। শ্রমিকদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ওই ফ্লোরের সংশ্লিষ্ট ও দায়িত্বপ্রাপ্তদের বরখাস্ত করার সিদ্ধান্তও নিয়েছি। কিন্তু তার পরও তারা আন্দোলনে নেমেছেন।’
কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়- যদি সত্যিই সময়মতো ছুটি দেওয়া হতো, তাহলে কি এই মৃত্যু এড়ানো যেত না?
আরও পড়ুন:
বিশেষজ্ঞ যা বলেন
এটাই বাংলাদেশের পোশাক খাতের বাস্তব চিত্র- যেখানে উৎপাদনের গতি ও টার্গেটই যেন সবকিছু, শ্রমিকের শারীরিক বা মানসিক অবস্থার গুরুত্ব সেখানে অনেক নিচে।
শ্রমিকরা জানান, কারখানায় অসুস্থতার কথা জানালেও অনেক সময় তারা ছুটি পান না। ছুটি নিলে কর্তৃপক্ষের চোখে তারা ‘কমিটমেন্টহীন কর্মী’। ফলে বাধ্য হয়ে অনেকেই শারীরিক কষ্ট সহ্য করেই কাজ করেন।
রিনার মৃত্যুতে এই খাতের নিষ্ঠুরতা দিকটি আবারও উন্মোচন করেছে। একদিকে পোশাক খাতের সাফল্যের গল্প- রপ্তানি আয়ে নতুন রেকর্ড, বিদেশি ব্র্যান্ডের আস্থা- অন্যদিকে মজুরি, নিরাপত্তা আর মর্যাদার প্রশ্নে এখনও হতাশার বাস্তবতা। ২০১৩ সালের রানা প্লাজা ধসের পর শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিয়ে দেশ-বিদেশে আলোচনা ও নানা উদ্যোগ নেওয়া হলেও এখনও কর্মপরিবেশে অনেক ঘাটতি রয়ে গেছে। জরুরি চিকিৎসাসেবা, ফ্যাক্টরি হেলথ ইউনিট, মনিটরিং সেল- এসব কাগজে-কলমে থাকলেও বাস্তবে অনেক জায়গায় নেই বা অকার্যকর।
আরও পড়ুন:
কোনো বাধাই দমাতে পারেনি জান্নাতুলকে
বিশেষজ্ঞদের মতে, শ্রমিকের স্বাস্থ্যসেবা ও মানবিক আচরণ শুধু সামাজিক দায় নয়, এটি শিল্পের টেকসই উন্নয়নের শর্তও। কর্মী অসুস্থ হলে তাকে বিশ্রাম দিতে পারা, চিকিৎসা সুবিধা নিশ্চিত করা, নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা- এসব থাকলে উৎপাদনও দীর্ঘ মেয়াদে বাড়ে।
রিনার সহকর্মীরা বলেন, ‘আমরা কাজ করি, ঘাম ঝরাই, কিন্তু আমাদের কথা কেউ শোনে না। মৃত্যুর পরেই শুধু সবাই দেখে।’
নারায়ণগঞ্জের এই ঘটনার পর প্রশ্ন উঠেছে- আর কত রিনা মারা গেলে আমরা শিখব যে শ্রমিক শুধু ‘হাত’ নয়, তিনি একজন মানুষও? শিল্পের উন্নতির পাশাপাশি যদি মানবিক মূল্যবোধ ও কর্মপরিবেশের নিরাপত্তা না আসে, তবে এই খাতের অর্জন সব সময়ই অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।
আরও পড়ুন:
কন্যাসন্তানের প্রতি বৈষম্য নয়