পুলিশের মাথাব্যথা এখন দুই সাজ্জাদ
চট্টগ্রামে আধিপত্য নিয়ে একের পর এক খুন
চট্টগ্রামে একের পর এক হত্যাকাণ্ডের জেরে মহানগর ও জেলা পুলিশের মাথাব্যথার বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছেন দুই সাজ্জাদ। পলাতক শিবির সন্ত্রাসী সাজ্জাদ আলী খান ওরফে বড় সাজ্জাদ দেশের বাইরে বসে চট্টগ্রামের অপরাধ জগৎ নিয়ন্ত্রণ করছেন। আর ছোট সাজ্জাদ কারাবন্দি থাকলেও নিজ হাতে ধরে রেখেছেন আধিপত্যের নাটাই। তাদের নীলনকশায় সংঘটিত একের পর এক খুন-খারাবির লাগাম টানতে মরিয়া হয়ে উঠেছে পুলিশ। দুই সাজ্জাদের চাঁদাবাজি, খুন-খারাবিসহ অপরাধ কর্মকাণ্ড রোধে তাদের অস্ত্রধারী হাতগুলো (সহযোগী) নিষ্ক্রিয়করণে বিশেষ অভিযান শুরু করেছে পুলিশ। পাশাপাশি মাঠে নেমেছে র্যাবও।
গত বুধবার বিএনপি মনোনীত সংসদ সদস্য প্রার্থী এরশাদ উল্লাহ সন্ত্রাসীদের গুলিতে আহত এবং সন্ত্রাসী সরোয়ার হোসেন বাবলা নিহত হওয়ার পর নড়েচড়ে বসেছে চট্টগ্রাম পুলিশ। আইজিপি বাহারুল আলমের বিশেষ নির্দেশনায় যে কোনো মূল্যে দুই সাজ্জাদের সব সহযোগীকে আইনের আওতায় আনতে চলছে পুলিশের জোর চেষ্টা।
চট্টগ্রামের অপরাধ জগতে বরাবরই সক্রিয় শিবির ক্যাডার হিসেবে পরিচিত সাজ্জাদ আলী খান ওরফে বড় সাজ্জাদ। নিজের আধিপত্য ধরে রাখতে বড় সাজ্জাদ নিজেই একসময় তার সহযোগী সরোয়ার হোসেন বাবলার ওপর চড়াও হতে নির্দেশ দেন। পুলিশ প্রশাসনও বিভিন্ন সময় একপক্ষকে দমন করতে অপর পক্ষকে ব্যবহার করে। সর্বশেষ সাজ্জাদ আলী খানের একসময়ের দুই শিষ্য সরোয়ার হোসেন বাবলা ও সাজ্জাদ হোসেন ওরফে ছোট সাজ্জাদ ওরফে বুড়ির নাতি সাজ্জাদ বিবাদে জড়িয়ে পড়েন। এ বিবাদে সরোয়ারসহ নিজ গ্রুপের সাত সহযোগী প্রতিপক্ষের গুলিতে নিহত হন। সরোয়ার হোসেন বাবলা নিহত হওয়ায় এখন অপরাধ জগতের একচ্ছত্র আধিপত্য চলে গেছে কারাবন্দি ছোট সাজ্জাদের হাতে। ছোট সাজ্জাদের পাশাপাশি তার স্ত্রী তামান্না শারমিনও বর্তমানে
কারাবন্দি। তবে সাজ্জাদের অন্তত পাঁচ থেকে ছয় সহযোগী কিলার অপরাধ জগতে পুরো মাত্রায় সক্রিয়। সরোয়ার হোসেন বাবলাসহ তার গ্রুপের সাতজনকে গত এক বছরে খুন করেছে তারা। এর বাইরে ভাড়াটে খুনি হিসেবে খুন করেছে আরও দুজনকে। বিপরীতে বাবলা ও তার সহযোগীরা সেই অর্থে কোনো প্রতিরোধই করতে পারেনি। যদিও পুলিশ প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতাদের ব্যাপক সহযোগিতা পেয়ে আসছিলেন বাবলা।
কারাগারে যাওয়ার আগে ছোট সাজ্জাদের স্ত্রী তামান্না শারমিন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, একসময় সরোয়ার ও ছোট সাজ্জাদ একসঙ্গে থেকেছে, প্রতিপক্ষের ওপর ককটেল ফাটিয়েছে, সবকিছু করেছে। কিন্তু পরে বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হওয়ার পর দুজনের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়।
আরও পড়ুন:
আকতার পারভেজ সর্বোচ্চ ভোটে সিএসই পরিচালক
চট্টগ্রামের পুলিশ কমিশনার মো. হাসিব আজিজ আমাদের সময়কে বলেন, আমরা সবদিক বিবেচনায় রাখছি। সব ধরনের সম্ভাবনার কথা মনে রেখেই আমাদের কার্যক্রম চালাচ্ছি। ছোট সাজ্জাদের সহযোগীদের বেপরোয়া অবস্থা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তারা অপরাধ করছে, কিন্তু পার পাবে না। আমাদের একটু সময় লাগছে। তবে তারা অবশ্যই ধরা পড়বে।
ছোট সাজ্জাদের সহযোগী মোহাম্মদ হাসান (৩৬), মোবারক হোসেন ইমন (২২), মো. খোরশেদ (৪৫), রায়হান আলম ওরফে রেকান আলম (৩৫) ও বোরহান (২৭) বর্তমানে মাঠপর্যায়ে অত্যন্ত সক্রিয়। তাদের মধ্যে শুটার হিসেবে সর্বাধিক পরিচিতি পেয়েছেন রায়হান। তার বাড়ি পূর্ব রাউজানে, বাবার নাম বদিউল আলম। গত বুধবার সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক এবং চট্টগ্রাম-৮ আসনে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী এরশাদ উল্লাহ নগরীর বায়েজিদ বোস্তামি থানার হাজিপাড়া এলাকায় নির্বাচনী প্রচারে গেলে সেখানে উপস্থিত সরোয়ার হোসেন বাবলাকে মাথায় অস্ত্র ঠেকিয়ে একাধিক গুলি করে খুন করে সন্ত্রাসীরা। সন্ত্রাসীদের ছোড়া গুলিতে বিদ্ধ হন এরশাদ উল্লাহও। বাবলার মাথায় অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করার যে ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে, তা দেখে পুলিশ নিশ্চিত, রায়হানই পিস্তল দিয়ে গুলি করেছে।
চট্টগ্রাম নগর পুলিশের উপকমিশনার (উত্তর) আমিরুল ইসলাম বলেন, গুলিটা যে করেছে, তার নাম রায়হান বলে আমরা জানতে পেরেছি। আমরা আরও যাচাই-বাছাই করছি। ঘটনায় জড়িত অন্যদেরও শনাক্ত করার চেষ্টা চলছে।
জানা যায়, গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর চট্টগ্রামে হঠাৎ করেই অপরাধ জগতের নিয়ন্ত্রকরা সক্রিয় হয়ে ওঠে। গত বছরের ৩০ আগস্ট হাটহাজারীর কুয়াইশে মাসুদ কায়সার ও মো. আনিস নামে দুজনকে খুন করে ছোট সাজ্জাদের সহযোগীরা। ২১ অক্টোবর নগরীর চান্দগাঁও শমসেরপাড়া চায়ের দোকানে ঢুকে খুন করে আফতাব উদ্দিন তাহসিন নামের এক যুবককে। এ দুই কাণ্ডের পর পুলিশ ছোট সাজ্জাদকে গ্রেপ্তার করতে সক্রিয় হয়ে ওঠে। গত ১৫ মার্চ ঢাকার বসুন্ধরা শপিংমল থেকে গ্রেপ্তার হন ছোট সাজ্জাদ। এ সময় স্ত্রী তামান্না শারমিন সঙ্গে থাকলেও কৌশলে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। ছোট সাজ্জাদের বিশ^াস, বাবলা ও তার সহযোগীরাই তাকে পুলিশের হাতে ধরিয়ে দিয়েছে। এ কারণে সাজ্জাদের সহযোগীরা বাবলাকে হামলার জন্য লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে। গত ৩০ মার্চ নগরীর বাকলিয়া সংযোগ সড়কে বাবলাকে বহনকারী একটি গাড়ি ধাওয়া করে ছোট সাজ্জাদের সহযোগীরা। গাড়িটি চন্দনপুরা পৌঁছলে মোটরসাইকেলে আসা সন্ত্রাসীরা সেটি লক্ষ্য করে ব্রাশফায়ার করে। এতে ঘটনাস্থলে বখতেয়ার হোসেন মানিক ও মো. আবদুল্লাহ আল রিফাত নামে দুজন খুন হন। পুলিশ সে সময় জানিয়েছিল, ওই কারে চালকের পাশের আসনে বসা ছিলেন বাবলা, ভাগ্যক্রমে তিনি বেঁচে যান। এ ঘটনার দুমাস পর পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকতের কাছে বাবলার আরেক সহযোগী ঢাকাইয়া আকবরকে গুলি করে হত্যা করে ছোট সাজ্জাদের লোকজন। সর্বশেষ গত ৫ নভেম্বর সরোয়ার নিজেই খুন হন।
আরও পড়ুন:
বৃহত্তম হিমশৈল
নিজেদের মধ্যে এসব খুন খারাবির বাইরেও ছোট সাজ্জাদের লোকজন ভাড়াটে খুনি হিসেবে গত ২৫ অক্টোবর রাউজানে যুবদল নেতা মো. আলমগীরকে খুন করে। এর আগে গত ১১ এপ্রিল রাউজানে খুন করে ইব্রাহিম নামে একজনকে। গত ২৩ জুলাই ৫০ লাখ টাকা চাঁদা না পেয়ে নগরীর বাকলিয়া এলাকায় ইউনুস নামে এক ব্যবসায়ীকে চারটি গুলি করে সাজ্জাদের লোকজন। সৌভাগ্যক্রমে তিনি বেঁচে যান।
একের পর এক এমন হত্যাকাণ্ডের জেরে ছোট সাজ্জাদের সহযোগীরা এখন পুলিশের মাথাব্যথার বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সূত্র জানায়, চট্টগ্রামের চকবাজার, পাঁচলাইশ থানার চালিতাতলী, বায়েজিদ থানার হামজারবাগ, হাজিপাড়া ও ওয়াজেদিয়া এবং হাল আমলে অনন্যা আবাসিক এলাকা ও চাঁন্দগাঁও থানার কিছু এলাকার জমি বিক্রি ও ভবন নির্মাণ থেকে ছোট সাজ্জাদ ও বাবলা চাঁদা নিতেন। এর বাইরে ওই পুরো এলাকার ইট, বালু ও কংক্রিটের ব্যবসাও তারাই নিয়ন্ত্রণ করেন। বিদেশে থাকা সাজ্জাদ আলী খানের কাছে এর একটি বড় অংশ চলে যায়। অবশিষ্ট টাকা মাঠের সহযোগীদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা হয়।
মামলা : বিএনপি নেতা এরশাদ উল্লাহর গণসংযোগের সময় বাবলা খুনের ঘটনায় ২৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এ ঘটনায় র্যাব যুবদলের এক নেতাসহ দুজনকে গ্রেপ্তার করেছে। বিদেশে পলাতক বড় সাজ্জাদ ও তার বাহিনীর কিলিং স্কোয়াডের প্রধান হিসেবে পরিচিত রায়হান আলমসহ সাতজনের নাম মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে। অন্য আসামিরা হলেন বোরহান উদ্দিন, নেজাম উদ্দিন, আলাউদ্দিন, মোবারক হোসেন ওরফে ইমন ও হেলাল ওরফে মাছ হেলাল।
মামলার এজাহারে বাবলার বাবা উল্লেখ করেছেন, বিদেশে পলাতক সাজ্জাদ আলী দীর্ঘদিন ধরে বাবলাকে হত্যার হুমকি দিয়ে আসছে। সর্বশেষ গত ২ নভেম্বর তাকে মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে বলেছিল- সময় শেষ, যা খাওয়ার খেয়ে নে। এরপর গত ৫ নভেম্বর সন্ধ্যায় এরশাদ উল্লাহর সঙ্গে নির্বাচনী প্রচারে বাবলাকে সরাসরি গুলি করে হত্যা করা হয়। সাজ্জাদের নির্দেশে তার অনুসারীরা পরিকল্পিতভাবে এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে বলে মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়।
আরও পড়ুন:
কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম