ব্যাংকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহারে হচ্ছে নীতিমালা
দেশের ব্যাংক ও আর্থিক খাতে এবার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই), মেশিন লার্নিং (এমএল) এবং লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল (এলএলএম) ব্যবহারের নীতিমালা প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ লক্ষ্যে ৭ সদস্যের একটি টিম গঠন করা হয়েছে, যারা আগামী দুই মাসের মধ্যে নীতিমালার খসড়া প্রণয়ন করবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের আইসিটি বিভাগের অধীনে গঠিত এই টিম ব্যাংক ও আর্থিক খাতে এআইভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, নীতি সহায়তা ও গ্রাহকসেবা উন্নয়নে উপযোগী একটি কাঠামো তৈরি করবে। একই সঙ্গে তথ্যনিরাপত্তা, ডেটা গভর্নেন্স এবং এআইয়ের নৈতিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে একটি সমন্বিত নীতিমালা তৈরি করাই হবে এ টিমের মূল লক্ষ্য। বাংলাদেশ ব্যাংক মনে করছে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহারের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ আর্থিত খাতে দক্ষতা ও স্বচ্ছতা বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে। কারণ এআই প্রযুক্তি সাইবার নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি বড় ডেটা বিশ্লেষণ করে দ্রুত ও সঠিক সিদ্ধান্ত দিতে
সক্ষম হবে, যা ব্যাংকের নীতিনির্ধারণ, ঝুঁকি মূল্যায়ন এবং ঋণ অনুমোদনের প্রক্রিয়াকে আরও গতিশীল করে তুলবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, সরকারি খাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকই প্রথম এ ধরনের নীতিমালা করার উদ্যোগ নিয়েছে। আর্থিক খাতেও এ ধরনের উদ্যোগ প্রথম। এই উদ্যোগ শুধু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ কাজের গতি বাড়াবে না, বরং দেশের আর্থিক খাতে নীতি প্রণয়ন ও তদারকিতে নতুন মাত্রা যোগ করবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইতোমধ্যে একাধিক পরীক্ষামূলক প্রয়োগে দেখেছে, জেনারেটিভ এআই ব্যবহারের
আরও পড়ুন:
একে আবদুল মোমেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী
মাধ্যমে প্রতিবেদন প্রস্তুত, অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ এবং নিয়মিত রেগুলেটরি কমপ্লায়েন্স পর্যবেক্ষণ অনেক সহজ ও সময়সাশ্রয়ী। এ জন্যই এখন একটি আনুষ্ঠানিক নীতিমালা তৈরি করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, যাতে সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকগুলো এই প্রযুক্তি গ্রহণে দিকনির্দেশনা পায়।
৭ সদস্যের টিম গঠন ও কার্যপরিধি : বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্বিক কার্যক্রমে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বাস্তবায়নে গত ২৩ অক্টোবর ৭ সদস্যের একটি টিম গঠন করে অফিস আদেশ জারি করা হয়েছে। কমিটির প্রধান করা হয়েছে এন্টারপ্রাইস রিস্ক ম্যানেজমেন্ট বিভাগের যুগ্ম পরিচালক (আইসিটি) ড. নুরুল্লাহ শাহীনকে। টিমের অন্য সদস্যরা হলেন- ইনফরমেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন টেকনোলজি ডিপার্টমেন্ট-২ এর উপপরিচালক (আইসিটি) মো. বেলাল হোসেন ও মোহা. নুরুল ইসলাম, সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ ইয়াসবির চৌধুরী, কাজী মো. আরিফুল হক, মো. সাঈদ হাসান ও সায়েদ আবরার জাওয়াদ। এই টিমের কাজের পরিধি নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। টিমটি ইতোমধ্যে অন্যান্য দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এআই নীতিমালা পর্যলোচনা শুরু করেছে। নীতিমালায় কিছু বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হবে। এগুলো হলোÑ এআই ব্যবহারে ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ ডেটা যাতে কোনোভাবেই ঝুঁকির মধ্যে না পড়ে তা নিশ্চিত করা হবে। এআইনির্ভর সিদ্ধান্ত যেন মানবিক মূল্যবোধ, ন্যায্যতা ও স্বচ্ছতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ থাকে তা নিশ্চিত করা এবং কর্মকর্তাদের এআই ব্যবহারে প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা উন্নয়নের ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, টিমের সদস্যরা প্রথম ধাপে নিরাপত্তা ও দক্ষতাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে উন্নতমানের এআইভিত্তিক অবকাঠামো ও প্রি-ট্রেইনড লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল (এলএলএম) সংগ্রহ করবেন। এই মডেলগুলো একটি নিরাপদ স্থানীয় সার্ভারে স্থাপন করা হবে, যাতে সংবেদনশীল আর্থিক তথ্যের গোপনীয়তা সম্পূর্ণ বজায় থাকে। এই পদক্ষেপের মূল লক্ষ্য হলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দৃষ্টিকোণ থেকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কার্যকারিতা প্রদর্শন করা। পাশাপাশি জেনারেটিভ এআই ব্যবহারের পরিধি শুধু একটি বিভাগে সীমাবদ্ধ না রেখে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ ও কাজেও সম্প্রসারিত করা হবে। প্রাথমিকভাবে ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ, বৈদেশিক মুদ্রানীতি বিভাগ, গবেষণা বিভাগ, মুদ্রানীতি বিভাগ এবং পেমেন্ট সিস্টেমস বিভাগকে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। ফলে এসব বিভাগে এআইয়ের সহায়তায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ আরও দ্রুত, তথ্যভিত্তিক এবং নির্ভুল হবে বলে কর্মকর্তারা মনে করছেন।
এ বিষয়ে ইনফরমেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন টেকনোলজি ডিপার্টমেন্ট-২ এর দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক জাকির হাসান আমাদের সময়কে বলেন, ভবিষ্যতে ব্যাংক খাতে এআইয়ের ব্যবহার নিরাপদ এবং যথাযথ করাই এ নীতিমালা করার লক্ষ্য। এর আওতায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ ব্যাংক খাতে এআইয়ের সঠিক ব্যবহারের ওপর জোর দেওয়া হবে। অর্থাৎ এআইয়ের সীমিত ও সুনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের পদক্ষেপ থাকবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটি বাস্তবায়ন হলে কর্মংসংস্থান সংকুচিত হবে না, বরং সম্প্রসারিত হবে। কারও চাকরি যাবে না। উল্টো এআই ব্যবহারের দক্ষতা অর্জনকারীদের সহজে চাকরি হবে।
যেসব ক্ষেত্রে এআই ব্যবহারের পরিকল্পনা: ঋণগ্রহীতার আর্থিক সক্ষমতা বিশ্লেষণ, বাজার ঝুঁকি, ঋণ ঝুঁকি এবং তারল্য ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় এআই প্রযুক্তি ব্যবহৃত হবে। বৃহৎ পরিসরের অর্থনৈতিক ডেটা বিশ্লেষণ করে প্রবৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতি এবং বৈদেশিক মুদ্রার স্থিতিশীলতা সম্পর্কে সময়োপযোগী ধারণা পাওয়া যাবে। ব্যাংকিং সিস্টেমে অনুপ্রবেশ, জাল লেনদেন বা হ্যাকিং প্রতিরোধে এআই-চালিত সাইবার মনিটরিং ব্যবস্থা চালু করা হবে। গ্রাহকের আচরণ বিশ্লেষণ, জাল লেনদেন শনাক্তকরণ ও ব্যক্তিগতকৃত সেবা প্রদানে এআই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এ ছাড়া ব্যাংকের নীতি ও বিধিবিধান বাস্তবায়ন পর্যবেক্ষণে এআই ভিত্তিক স্বয়ংক্রিয় নজরদারি ব্যবস্থা তৈরি করা হবে।
সম্প্রতি বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) উদ্যোগে ব্যাংক খাতের সাইবার নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার নিয়ে গোলটেবিল আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে উপস্থাপিত মূল প্রবন্ধে বলা হয়, দেশের ৬০ শতাংশ ব্যাংকেরই সাইবার নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এআই ব্যবহারের নীতিমালা নেই। ৪০ শতাংশ ব্যাংকের এই নীতিমালা রয়েছে। এ ছাড়া এআই ব্যবহার করে ব্যাংক পরিচালনার নীতিমালা নেই ৬৮ শতাংশ ব্যাংকের।
মূল প্রবন্ধে বিআইবিএমের পরিচালক মো. শিহাব উদ্দিন খান বলেন, পুরো বিশ্বেই আর্থিক খাতসহ সব ধরনের খাতে আধুনিকায়ন হয়েছে। সে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সাইবার হামলা। সেখানে আর্থিক খাত নিয়মিতভাবেই অন্যতম টার্গেট হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাই এই খাতে নিরাপত্তা বাড়াতে হলে এআই ব্যবহার প্রয়োজন।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর নুরুন নাহার বলেন, অনলাইন ব্যাংকিং, ইন্টারনেট ও টেলিযোগাযোগনির্ভর ব্যাংকিং কার্যক্রম বিশ্বব্যাপী ব্যাংক খাতের কেন্দ্রবিন্দু। এআই ব্যবহার করে ব্যাংকগুলো সহজে অস্বাভাবিক কার্যক্রম শনাক্ত, ম্যালওয়্যার ও জালিয়াতি প্রতিরোধ কার্যকরভাবে করতে পারবে।
আরও পড়ুন:
পাল্টে যেতে পারে আন্দোলনের ধরন