নতুন দিগন্তে সফল হোক কৃষক

রিশাদ আহমেদ
০৬ নভেম্বর ২০২৫, ০৭:৩৮
শেয়ার :
নতুন দিগন্তে সফল হোক কৃষক

বাংলাদেশের মাঠে এখন এক নতুন স্রোত বইছে। ধানের চারা রোপণের সময় যেখানে একসময় শুধু কৃষকের ঘাম ঝরত, এখন সেখানে তরুণদের হাতে দেখা যাচ্ছে স্মার্টফোন, সেন্সর, এমনকি ড্রোনও। সময় বদলেছে, কৃষির ধরনও বদলাচ্ছে। নতুন প্রজন্মের তরুণরা আজ নিজেদের উদ্ভাবনী চিন্তা, প্রযুক্তি ও ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে গড়ে তুলছেন ‘কৃষি স্টার্টআপ’- যা দেশের কৃষিক্ষেত্রে খুলে দিচ্ছে এক নতুন দিগন্ত।

দেশের অর্থনীতি দীর্ঘদিন ধরে কৃষিনির্ভর। কৃষি খাত দেশের মোট শ্রমশক্তির প্রায় ৪০ শতাংশের জীবিকা নির্ভর করে। কিন্তু যুগের পরিবর্তনে কৃষির প্রতি তরুণদের আগ্রহ ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছিল। শহরমুখী কর্মসংস্থান, অনিশ্চিত ফসলের দাম, আবহাওয়ার অনিশ্চয়তা ও মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রভাব কৃষিকে অনেকের কাছে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছিল।

এমন পরিস্থিতিতেই গত কয়েক বছরে কৃষিভিত্তিক স্টার্টআপ বা উদ্ভাবনী উদ্যোগগুলো ধীরে ধীরে আলোচনায় আসে। প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে তরুণরা শুরু করেছেন নানা ধরনের কৃষিসেবা, পণ্য বিপণন ও তথ্যভিত্তিক পরামর্শ কার্যক্রম। কৃষক-বাজার-ভোক্তা- এই তিন স্তরকে একসূত্রে বাঁধছে এই নতুন ধারার উদ্যোক্তারা।

বাংলাদেশ ইনোভেশন ফোরামের তথ্যমতে, দেশে বর্তমানে অন্তত ৫০টির বেশি কৃষিভিত্তিক স্টার্টআপ সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- ‘ফসল’, ‘অ্যাগ্রিপ্রেনিউর’, ‘গো-গ্রিন’, ‘হালচাষ’, ‘রাইস-টেক’ প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান। এসব উদ্যোগ প্রযুক্তি ও তথ্যের মাধ্যমে কৃষকের উৎপাদন, বিপণন ও আয়ের সুযোগ বাড়াচ্ছে।

উদাহরণ হিসেবে রাজশাহীর তরুণ সাকিব হোসেন প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘ফসল’ নামের একটি অ্যাগ্রিটেক প্রতিষ্ঠান। তারা মাটির গুণমান যাচাই থেকে শুরু করে বীজ ও সার ব্যবহারের পরামর্শ পর্যন্ত ডিজিটালভাবে প্রদান করছে। এতে একদিকে উৎপাদনশীলতা বাড়ছে, অন্যদিকে খরচও কমছে।

‘ডিজিটাল অ্যাগ্রিকালচার নেটওয়ার্ক’-এর সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রযুক্তিভিত্তিক কৃষি ব্যবস্থাপনায় ফসলের গড় উৎপাদন ১৫ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ছে, একই সঙ্গে কীটনাশক ও সারের অপচয় কমছে প্রায় ৩০ শতাংশ পর্যন্ত। এসব উদ্যোগের মাধ্যমে কৃষকের হাতে ফিরছে লাভের একটি ন্যায্য অংশ।

কৃষি স্টার্টআপের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির পেছনে রয়েছে কয়েকটি মৌলিক কারণ। এক. প্রযুক্তির প্রসার। গ্রামাঞ্চলে স্মার্টফোন ও ইন্টারনেট সেবার সহজলভ্যতা তথ্যপ্রাপ্তিকে সহজ করেছে। ফলে কৃষকরা সময়মতো আবহাওয়ার খবর, রোগ-পোকামাকড়ের তথ্য ও বাজারদর জানতে পারছেন। দুই. তরুণদের উদ্যোক্তা মনোভাব। বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া অনেক তরুণ আজ কৃষিকে নতুন করে দেখছেন। তারা বুঝেছেন, এই খাতে সম্ভাবনা অপরিসীম। কৃষি-স্টার্টআপের মাধ্যমে কেউ ড্রোনভিত্তিক সার প্রয়োগ ব্যবস্থা চালু করছেন, কেউ আবার সরাসরি কৃষক-ক্রেতা সংযোগ গড়ে তুলছেন। তিন. নীতিগত সহায়তা। সরকারের তরফ থেকেও ‘স্টার্টআপ বাংলাদেশ’, ‘ই-কৃষি তথ্যকেন্দ্র’ ও বিভিন্ন ঋণ প্রকল্পের মাধ্যমে সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্যোগে এখন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে কৃষি পরামর্শ পাওয়া যাচ্ছে, যা তরুণ উদ্যোক্তাদের কাজে লাগছে। চার. বাজার-সংযোগ ও স্বচ্ছতা। আগে কৃষক-ভোক্তার মধ্যে একাধিক মধ্যস্বত্বভোগী থাকায় কৃষকের প্রাপ্য লাভের অংশ কমে যেত। এখন মোবাইল-অ্যাপ ও অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে সেই ব্যবধান দ্রুত কমছে। ফলে কৃষক সরাসরি বিক্রি করতে পারছেন, আর ভোক্তাও পাচ্ছেন তাজা পণ্য।

তবে এই খাতের সাফল্য টিকিয়ে রাখতে দরকার পরিকল্পিত উদ্যোগ ও সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্ব। গ্রামীণ অঞ্চলে ডিজিটাল অবকাঠামো আরও উন্নত করতে হবে। ইন্টারনেট সেবা ও স্মার্টফোন ব্যবহারের সুযোগ বাড়লে কৃষকের তথ্যপ্রাপ্তি সহজ হবে। তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য সহজ শর্তে কৃষিভিত্তিক ঋণ বা ভেঞ্চার ক্যাপিটাল বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি করতে হবে। অনেক তরুণ আইডিয়া থাকলেও মূলধনের অভাবে থেমে যান। কৃষকদের প্রশিক্ষণ বাড়ানো দরকার। আধুনিক যন্ত্রপাতি, ড্রোন বা স্যাটেলাইটভিত্তিক কৃষি তথ্য ব্যবহার করতে তাদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিতে হবে। বাজার-সংযোগ আরও সুসংগঠিত করা জরুরি। অনলাইন মার্কেটপ্লেস বা কৃষিপণ্য পরিবহনে লজিস্টিক সাপোর্ট না থাকলে কৃষকের লাভ কমে যায়। এই দিকটিতে সরকারি বিনিয়োগ বাড়ানো প্রয়োজন। নীতিগত সুরক্ষা দিতে হবে। কৃষি স্টার্টআপ যেন আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় না পড়ে- তা নিশ্চিত করা জরুরি। একই সঙ্গে তথ্য নিরাপত্তা, পণ্যের মাননিয়ন্ত্রণ ও প্রযুক্তি ব্যবহারে স্বচ্ছতা বজায় রাখতে হবে।

কৃষি অর্থনীতিবিদদের মতে, আগামী পাঁচ বছরে এই খাতের মাধ্যমে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অন্তত এক লাখ তরুণের কর্মসংস্থান হতে পারে। তবে তারা সতর্ক করে দিয়েছেন, সঠিক তত্ত্বাবধান ও মানসম্মত সেবা না পেলে উদ্যোগগুলো টেকসই নাও হতে পারে।

দেশের অর্থনৈতিক ইতিহাসে কৃষি যেমন আমাদের আত্মার অংশ, তেমনি নতুন প্রজন্মের উদ্যোক্তারা এখন সেটিকে পুনর্গঠনের পথে নিয়ে যাচ্ছেন। কৃষি স্টার্টআপ তাদের হাতে কেবল একটি পেশা নয়, বরং একটি সম্ভাবনার নাম হয়ে উঠেছে। যদি প্রয়োজনীয় সহায়তা, প্রশিক্ষণ ও বিনিয়োগ নিশ্চিত করা যায়, তাহলে এই তরুণ নেতৃত্বাধীন উদ্যোগগুলো দেশের খাদ্যনিরাপত্তা, রপ্তানি আয়ে এবং টেকসই উন্নয়নে যুগান্তকারী ভূমিকা রাখতে পারবে।


মো. রিশাদ আহমেদ : শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা