বিপদ জেঁকে বসেছে পোশাক খাতে

আব্দুল্লাহ কাফি
০৫ নভেম্বর ২০২৫, ০২:১২
শেয়ার :
বিপদ জেঁকে বসেছে পোশাক খাতে

বিপদ জেঁকে বসছে দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান উৎস তৈরি পোশাক খাতের ওপর। বিপদ যেন কোনোভাবেই ছাড়ছে না। একটি বিপদ কাটিয়ে উঠলে আরেকটি হাজির। এদিকে অর্ডার কমে যাওয়ায় টানা তিন মাস উৎপাদন ও রপ্তানি কমেছে। ট্রাম্প প্রশাসনের বাড়তি শুল্ক আরোপের ফলে চীন এখন হন্যে হয়ে ইউরোপের বাজার দখলের চেষ্টা করছে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশি পোশাক খাতের ওপর।

খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একের পর এক কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। গত এক বছরে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন লাখেরও বেশি শ্রমিক। নতুন সংকট যুক্ত হয়েছে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কার্গো ভিলেজ পুড়ে যাওয়ার ঘটনা। এতে শিল্পের কাঁচামাল পুড়ে ক্ষতি হয়েছে প্রায় বিলিয়ন ডলারের। প্রায় ২৫০টি কারখানার

পণ্য পুড়ে যাওয়ার শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। এতে আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এর মধ্যে রয়েছে দেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা। নির্বাচন সামনে রেখে ক্রেতারা অর্ডার কমিয়ে দিয়েছেন।

এর সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হয়েছে ব্যাংক খাতের নৈরাজ্য। বিগত সরকারের আমলে ব্যাংক খাতে লুটপাটের কারণে এর প্রভাব পড়েছে এখন। রপ্তানিকারকরা তাঁদের প্রয়োজন অনুযায়ী এলসি করতে পারছেন না, এমনকি শ্রমিকের বেতনের টাকাও ব্যাংক থেকে তুলতে পারছেন না।

বর্তমানে সব কিছু নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে বলে মনে করছেন নিটওয়্যার পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ ও রপ্তানিকারক শিল্প মালিকদের সংগঠন ইএবির সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম। গতকাল আমাদের সময়কে তিনি বলেন, এখন সব কিছু আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। অনেক দিন ধরে আমরা সরকারকে বলে আসছি, এমন পরিস্থির শিকার হতে হবে। কিন্তু কেউ গুরুত্ব দেয়নি। এখন রপ্তানিকারকরা দিশাহারা হয়ে পড়েছেন। তিনি বলেন, অর্ডার না এলে উৎপাদন হবে না, এটাই স্বাভাবিক। গত তিন মাস ধরে ধারাবাহিকভাবে রপ্তানি কমছে। কারখানা বন্ধ হচ্ছে। শ্রমিক বেকার হচ্ছেন। এতে নতুন করে অস্থিরতা তৈরি হবে।

মোহাম্মদ হাতেম বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের পলিসিগুলো নতুন করে ভাবিয়ে তুলেছে। এ শিল্পের জন্য তা হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। নতুন করে প্রভিডেন্ট ফান্ড করে দিয়েছে। এতে অস্থিরতা আরও বাড়বে। প্রতি বছর শ্রমিকদের ইনক্রিমেন্ট দেওয়া হচ্ছে। এটা বাড়তি বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। মনে হচ্ছে, এ খাতে অস্থিরতা লাগিয়ে রাখতে বিদেশি এজেন্ট কাজ করছে।

অন্যদিকে রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সহ-সভাপতি মো. শিহাব উদ্দোজা চৌধুরী আমাদের সময়কে বলেন, বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উত্তোরণের জন্য সরকারের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। শিল্প মালিকদের নীতি সহায়তার পাশাপাশি ব্যাংক খাতের নৈরাজ্য বন্ধ করা প্রয়োজন। বিশেষ করে এক্সিম ব্যাংক ও এসআইবিএলÑ এই দুই ব্যাংকে কোনো টাকা নেই। তাঁরা কোনো টাকা দিতে পারছে না। এমনকি এফডিআর ভেঙে যে শ্রমিকদের বেতন দেব, তাও করা যাচ্ছে না।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) দেওয়া হালনাগাদ তথ্যে উঠে এসেছেÑ দেশের মোট রপ্তানির ৮০ শতাংশই তৈরি পোশাক খাতের। টানা তিন মাস ধরে এ খাতের রপ্তানি কমেছে। তবে শুরুটা ছিল ভালো। অর্থবছরের শুরুতে গত জুলাই মাসে ৩৯৬ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল সাড়ে ২৪ শতাংশ। পরের মাসে রপ্তানি কমেছে পৌনে ৫ শতাংশ। আর সেপ্টেম্বরে কমেছিল প্রায় সাড়ে ৫ শতাংশ। গত মাসে, অর্থাৎ অক্টোবরে রপ্তানি হয়েছে ৩০২ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক। এই রপ্তানি গত বছরের অক্টোবরের তুলনায় ৮ শতাংশ কম।

ইপিবির তথ্যানুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে ১ হাজার ২৯৯ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে। এই রপ্তানি গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ১ দশমিক ৪০ শতাংশ বেশি। গত অর্থবছরের প্রথম চার মাসে রপ্তানি হয়েছিল ১ হাজার ২৮১ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক।

বিজিএমইএর তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছরে দেশে অন্তত ২৫৮টি পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এতে ১ লাখের বেশি শ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়েন। সম্প্রতি রাজধানীর বিজিএমইএ ভবনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান এ তথ্য দেন।

বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, বিগত এক বছরে ২৫৮টি কারখানা তাদের উৎপাদন বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে। অনেকে ক্ষুদ্র বা মাঝারি পরিসরে টিকে থাকার চেষ্টা করছে; কিন্তু ক্রমবর্ধমান ব্যয়, বিদ্যুৎসংকট, মজুরি সমন্বয় এবং আন্তর্জাতিক বাজারে অনিশ্চয়তার কারণে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে। তবে একই সময়ে নতুন ১৬৬টি কারখানা চালু হয়েছে। ফলে সামগ্রিকভাবে কর্মসংস্থান ও রপ্তানি সক্ষমতা উভয় ক্ষেত্রেই স্থিতিশীলতা নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।