ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে জানতে চায় আইএমএফ
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে অনিয়মের কারণে আর্থিক সংকটে পড়া পাঁচটি ব্যাংককে একীভূত করার উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে চেয়েছে ঢাকা সফররত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রতিনিধি দল। গতকাল আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও অর্থ বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়েছে। এসব ব্যাংককে কীভাবে একীভূত করা হবে, আমানতকারীরা কীভাবে তাঁদের টাকা ফেরত পাবেন, ব্যাংকগুলো একীভূতকরণে মূলধনের জোগান কীভাবে হবে, তা জানতে চেয়েছেন আইএমএফ কর্মকর্তারা।
যে পাঁচটি ব্যাংক একীভূত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে সেগুলো হলোÑ ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক ও এক্সিম ব্যাংক। এই পাঁচ ব্যাংকের মধ্যে প্রথম চারটি ছিল আর্থিক খাতের বিতর্কিত ও আওয়ামী লীগ সরকারঘনিষ্ঠ প্রতিষ্ঠান এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে। আর এক্সিম ব্যাংকও ছিল আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ আরেক ব্যবসায়ী নজরুল ইসলাম মজুমদারের নিয়ন্ত্রণে।
আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের ষষ্ঠ কিস্তির অর্থ ছাড় করার আগে বাংলাদেশ সফর করছে একটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল। গত ২৯ অক্টোবর থেকে বাংলাদেশে সফররত প্রতিনিধি দল অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে বৈঠক করছে। গতকাল আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও অর্থ বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে তারা।
ব্যাংক একীভূত করার প্রক্রিয়া নিয়ে জানতে চাওয়ার পাশাপাশি ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়তে থাকায় যখন ব্যাংকগুলোতে গুরুতর মূলধন ঘাটতি তৈরি হয়েছে, তখনও কেন এসব ব্যাংককে অবসায়নের আওতায়
আনা হচ্ছে না এবং কেন এখনও এসব ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বেতন ও বোনাস পাচ্ছেনÑ সে বিষয়েও জানতে চায় আইএমএফ।
আরও পড়ুন:
আকতার পারভেজ সর্বোচ্চ ভোটে সিএসই পরিচালক
তারা প্রশ্ন তোলে, এত দীর্ঘ সময় ধরে চলা এই পুনর্গঠন পরিকল্পনা কতটা কার্যকর? তাদের মতে, দীর্ঘদিন ধরে দুর্বল অবস্থায় ব্যাংকগুলোর টিকে থাকা দেশের আর্থিক খাতের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। তাই এসব ব্যাংকের পুনর্গঠন বা অবসায়নের জন্য এখনই সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।
জানা গেছে, পাঁচ দুর্বল ব্যাংক একীভূত করার বিষয়ে রোডম্যাপ তৈরি করা হয়েছে। রোডম্যাপটি শিগগির সরকারি গেজেটের মাধ্যমে ঘোষণা করা হবে এবং সেখানে উল্লেখিত কার্যকর তারিখ থেকে অর্থ ফেরতের সময়সূচি কার্যকর হবে। গেজেটের খসড়া এরই মধ্যে প্রস্তুত করা হয়েছে। ২ লাখ টাকার মধ্যে থাকা সঞ্চয়কে সুরক্ষিত আমানত হিসেবে গণ্য করা হবে এবং একীভূতকরণের পরপরই তা অবিলম্বে পরিশোধ করা হবে।
জানা গেছে, গত ৯ অক্টোবর উপদেষ্টা পরিষদ পাঁচটি ইসলামি ব্যাংক একীভূত করে একটি নতুন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক গঠনের অনুমোদন দিয়েছে। একীভূত ব্যাংকগুলো হলোÑ ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ও এক্সিম ব্যাংক। সরকারি সার্কুলারের খসড়া অনুযায়ী, ব্যক্তিগত আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দেওয়ার ধাপটি দুটি ভাগে বিভক্ত হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দেওয়া সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাচ্ছে, কারণ জন-আস্থা ব্যাংকিং খাতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
চলতি ও সঞ্চয়ী হিসাবে তিন মাস বা তার বেশি মেয়াদের আমানত বাদে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থকে সুরক্ষিত আমানত হিসেবে গণ্য করা হবে এবং তা প্রথমেই পরিশোধ করা হবে। গেজেটে উল্লেখিত কার্যকর তারিখের পর যে কোনো সময় এই অর্থ উত্তোলন করা যাবে। বড় অঙ্কের আমানতের ক্ষেত্রে অর্থ ফেরত দেওয়ার সময়সূচি কার্যকর তারিখের ছয় মাস থেকে ২৪ মাসের মধ্যে প্রতি কিস্তিতে ১ লাখ টাকা করে মোট ছয় কিস্তিতে ফেরত দেওয়া হবে। ২৪ মাসের পর অবশিষ্ট টাকা যে কোনো সময় পরিশোধযোগ্য হবে। তিন মাস বা তার বেশি মেয়াদের আমানতের ক্ষেত্রেও ২ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থকে সুরক্ষিত হিসেবে গণ্য করা হবে এবং সার্কুলার কার্যকর হওয়ার পর যে কোনো সময় তা তোলা যাবে। তিন মাস মেয়াদি স্থায়ী আমানত (ফিক্সড ডিপোজিট) তিনবার স্বয়ংক্রিয়ভাবে নবায়ন করা হবে, তারপর তা উত্তোলনের যোগ্য হবে। ছয় মাস মেয়াদি আমানত দুবার নবায়ন করা হবে, আর এক বছর মেয়াদি আমানতও দুবার নবায়ন করার পর পরিশোধযোগ্য হবে।
আরও পড়ুন:
বৃহত্তম হিমশৈল
দুই বছর মেয়াদি আমানত স্বয়ংক্রিয়ভাবে তিন বছরের মেয়াদে রূপান্তরিত হবে, তিন বছর মেয়াদি চার বছরে, আর চার বছর মেয়াদি পাঁচ বছর মেয়াদিতে রূপান্তরিত হবে। পাঁচ বছর বা তার বেশি মেয়াদের আমানত মেয়াদপূর্তির সঙ্গে সঙ্গে পরিশোধযোগ্য হবে।
সরকারি সার্কুলারের খসড়া অনুযায়ী, ৬৫ বছর বয়সের ঊর্ধ্বে এবং যারা ক্যানসারে আক্রান্ত, তাদের জন্য এই শর্তাবলী প্রযোজ্য হবে না। আমানতকারীরা তাঁদের বাকি থাকা ব্যালেন্সের সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বিনিয়োগ বা ঋণ সুবিধা হিসেবে গ্রহণ করতে পারবেন। গেজেটে উল্লেখিত কার্যকর তারিখ থেকে আমানতের ওপর বাজারভিত্তিক মুনাফা অর্জিত হবে।
নতুন ব্যাংকের জন্য দুটি নাম প্রস্তাব করা হয়েছে ইউনাইটেড ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড এবং সম্মিলিত ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড। একীভূত হলে নতুন ব্যাংকের অনুমোদিত মূলধন হবে ৪০ হাজার কোটি টাকা, যার মধ্যে ৩৫ হাজার কোটি টাকার পরিশোধিত মূলধনের প্রয়োজন। প্রাথমিক মূলধন পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার প্রতিষ্ঠানিক আমানত বেইল-ইন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ইক্যুইটিতে রূপান্তরিত হতে পারে। সরকার বাকি ২০ হাজার কোটি টাকা মূলধন সহায়তা প্রদান করবে, যার মধ্যে ১০ হাজার কোটি নগদ ও ১০ হাজার কোটি টাকা সুকুকের মাধ্যমে সংগৃহীত হবে, যা বন্ডের মতো শরিয়াহ সম্মত আর্থিক উপাদান।
নতুন ব্যাংকের বোর্ডে ৯ জন পরিচালক থাকবেন, যাঁদের মধ্যে পাঁচজন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়োগপ্রাপ্ত এবং চারজন প্রধান শেয়ারহোল্ডারদের মাধ্যমে মনোনীত হবেন। পরিচালকরা এক বছরের মেয়াদের জন্য দায়িত্ব পালন করবেন। প্রাথমিকভাবে অর্থ মন্ত্রণালয় সরকারের পক্ষে নতুন ব্যাংকের মালিকানা রাখবে। এই অংশ ধীরে ধীরে বেসরকারি খাতে হস্তান্তরিত হবে। সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী, তিন বছরের মধ্যে ব্যাংকে একটি কৌশলগত অংশীদার আনা হবে এবং পাঁচ বছরের মধ্যে এটি সম্পূর্ণভাবে বেসরকারিকরণ হওয়ার প্রত্যাশা করা হচ্ছে।
আরও পড়ুন:
কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম