এবার টার্গেট তাজমহল
ভারতের প্রথম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, স্বাধীনতা সংগ্রামী, জাতীয় কংগ্রেসের অন্যতম বিখ্যাত নেতা বল্লভভাই প্যাটেলের জন্মদিন ৩১ অক্টোবর ও তার জন্মের সার্ধশতবর্ষ। পাশাপাশি ওইদিনটি ছিল স্বাধীন ভারতের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী (ব্যক্তি হিসেবে তৃতীয়) ও জননেত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বলিদান দিবস বা শহীদ দিবস। কিন্তু আরএসএস ও বিজেপি বল্লভভাই প্যাটেলকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে উদযাপন করেছে দিনটিকে। ‘তাজ স্টোরি’ নামে একটা মুভি এদিন মুক্তি লাভ করে। এক অনাকাক্সিক্ষত বিষয় তাজমহলকে নিয়ে উসকে দিয়েছে ক্ষমতাসীন দক্ষিণপন্থি সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিস্ট দল বিজেপি ও আরএসএস। একদম শিল্পকলাকে ব্যবহার করেই কিন্তু বিজেপি-আরএসএস এটা করেছে। এই ছবিতে শিল্পকলাকে ধর্মীয় আবেগে ব্যবহার করে কীভাবে সাম্প্রদায়িকতাকে ব্যবহার করা হয়েছে তার জ্বলন্ত উদাহরণ হলো ‘তাজ স্টোরি’। মুসলিম শিল্পকলার অনন্য নিদর্শন সম্রাট শাহজাহান নির্মিত তার প্রিয়তমা স্ত্রী মমতাজ বেগমের প্রেম-সমাধি ও স্মৃতিসৌধ এবং বিশ্বের সপ্তাশ্চর্যের অন্যতম তাজমহল হয়ে গেল সাম্প্রদায়িক বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু। ভারতের উলঙ্গ সাম্প্রদায়িকতার মধ্যে বিজেপি-আরএসএসের বিষ ঢালাই হলো প্রধান উদ্দেশ্য। তাজমহল নাকি ‘তেজো মহালয়া’ নামে একটা শিবমন্দির ছিল। তার ওপরই নির্মিত এই তাজমহল নামের স্মৃতিসৌধ। ইতোমধ্যে ক্ষমতাসীন বিজেপি শিল্পকলাকে কাজে লাগিয়ে ‘দ্য বেঙ্গল ফাইলস’, ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’ ও ‘ কেরালা ফাইলস’ নিয়ে আমাদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক মুভি বা ছবিও করেছে। যেগুলো সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ও হইচই সৃষ্টি করেছে। এর ফলে তা ভোট মেরুকরণের কার্ড হিসেবে ব্যবহার করেছে বিজেপি-আরএসএস। এ রকমই আর একটি ছবি হলো ‘দ্য তাজ স্টোরি’। আরেকটু সাহসের সঙ্গেই বলা যায় যে, এটিও বলিউডের নতুন হিন্দুত্ববাদী পণ্য ও বিভাজনের রাজনীতি আরএসএস-বিজেপির। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার বিখ্যাত কবিতা ‘শা-জাহান’-এ বলছেন, ‘হীরা মুক্তামানিক্যের ঘটা/যেন শূন্য দিগন্তের ইন্দ্রজাল ইন্দ্রধনুচ্ছটা /যায় যদি লুপ্ত হয়ে যাক /শুধু থাক/একবিন্দু নয়নের জল /কালের কপোলতলে শুভ্র সমুজ্জ্বল /এ তাজমহল।’ আর জাতীয় কবি ও বিশ্বনন্দিত সুরসাধক কাজী নজরুল ইসলাম ‘নারী’ কবিতায় বললেন, ‘তাজমহলের পাথর দেখেছ, দেখিয়াছ তার প্রাণ?/অন্তরে তার মমতাজ নারী বাহিরেতে শা-জাহান।’ যেই দুই বিশ্বনন্দিত কবি-গীতিকার তাজমহলে মোহিত ও অভিভূত হয়ে এতকিছু কাব্যকথা আমাদের শোনালেন।? সেই তাজমহল আজ হিন্দুত্ববাদীদের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির খোরাক। বাবরি মসজিদের মতো ৫০০ বছরের ঐতিহাসিক জাতীয় সৌধকে শুধু ধ্বংস করেনি বিজেপি-আরএসএসের শীর্ষনেতাদের সামনেই, সেখানে মোদির জমানায় রামমন্দির হয়ে গেল। টার্গেট তাজমহল। এটা নাকি শিবমন্দির। ‘দ্য তাজ স্টোরি’ ছবি বা মুভি হলো তার একটি মহড়া। আরও অনেক কিছুকেই আরএসএস-বিজেপিসহ সঙ্ঘ পরিবার টার্গেট করেছে। খোদ পশ্চিমবঙ্গের বুকেই গৌড়-মালদহের সুলতানি আমলের আদিনা মসজিদ, নবাবী মুর্শিদাবাদের নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ নির্মিত কাটরা মসজিদ, নবাব সিরাজের মদিনা, মুর্শিদাবাদের বিখ্যাত ঈমামবাড়া, কলকাতার টালিগঞ্জের টিপু সুলতান মসজিদ ও ধর্মতলার টিপু সুলতান মসজিদ টার্গেট করেছে।
‘দ্য তাজ স্টোরি’তে অভিনয় করেছেন বলিউডের বিখ্যাত অভিনেতা পরেশ রাওয়াল। এই পরেশ রাওয়াল বিজেপির নেতাও। এর আগেও ২০১৬ সালে তিনি ‘সরদার’ ছবিতে বল্লভভাই প্যাটেলের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। এবার ‘দ্য তাজ স্টোরি’তে পরিচালক তুষার গোয়েল তাজমহলের বিরুদ্ধে সঙ্ঘ পরিবারকে আন্দোলনের বাড়তি পারদ ও জ্বালানি জোগাতে চাইছে বলে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ ও বিশ্লেষকরা মনে করছেন। নব্বইয়ের দশকে তৎকালীন বিজেপি সভাপতি বাবরিকে নিয়ে রামরথ যাত্রা করে ভারতের সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার পারদ বাড়িয়েছিলেন যার জেরস্বরূপ ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর বাবরি মসজিদ ধ্বংস ও ধূলিসাৎ হয়েছিল। আর মোদির জমানায় আদালতকে প্রহসন বানিয়ে বাবরি মসজিদ হলো রামমন্দির। এবার তাজমহলকে শিবমন্দির বানানোর বৃহত্তম পরিকল্পনা সঙ্ঘ পরিবারের যা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক।
২০১৪ নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর পরই তাজমহল নিয়ে বড় আকারের রাজনীতি শুরু হয়। সে সময় আগ্রার একটি আদালতে সাতটি মামলা দায়ের করে সঙ্ঘ পরিবার। দাবি করা হয়, তাজমহলকে যেন পুজো করার জন্য ছেড়ে দেওয়া হয়। ওই মামলাতে এ-ও দাবি করা হয় যে, তাজমহলের কক্ষগুলো যেন পরীক্ষা করে দেখা হয় যে, সেখানে অন্য কোনো ধর্মের কোনো চিহ্ন আছে কি না। মামলাকারী আগাম দাবিও করেন যে, তাদের কাছে অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন রয়েছে। বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে রাজনৈতিক প্রচারধর্মী বয়ানে রূপ দিয়েছিলেন মামলাকারীরা। তবে আগ্রার আদালত এ নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার বা দেওয়ার কোনো প্রয়োজনই মনে করেননি। কিন্তু বিজেপি-আরএসএসসহ সঙ্ঘ পরিবার থেমে না গিয়ে ২০২২ সালে উত্তরপ্রদেশের এলাহাবাদ (প্রয়াগরাজ) হাইকোর্টে সমমানের আরও একটি মামলা করে। সেখানেও মামলাকারীরা তাজমহলের ২০টি কক্ষ খোলার আবেদন করেন। এলাহাবাদ হাইকোর্টও মামলার কোনো সিদ্ধান্ত নিতে বা দিতে পারেননি। আদালত বুঝতে পেরেছিলেন যে, মোগলদের তৈরি বলে তাজমহলকে কলঙ্কিত করা হচ্ছে। কেবল ভোট মেরুকরণ করার জন্য। মোদ্দা কথা এটাই বিজেপি-আরএসএস যা করছে তা স্রেফ ভোটব্যাংকের জন্য। এলাহাবাদ হাইকোর্টের দুই বিচারপতি ডি কে উপাধ্যায় ও সুভাষ বিদ্যার্থী বলেই দিয়েছিলেন, এভাবে জনস্বার্থ মামলা চলতে আদালতকেও বলা হয়েছিল, এর নিচে কিছু আছে বা এ নিয়েও? আবেদন করাও হবে। খননকার্যের আর্জি বা খুলে দেখার আর্জি জানানোও হবে।
ওই সময় আরএসএসের প্রচারে গতি বাড়াতে গিয়ে রাজস্থানের জয়পুরের মহারাজা মান সিং-এর নাতনি দিয়া কুমারী দাবি? করেন যে, তাজমহল নাকি তাদের দান করা জমিতে নির্মিত। এখন তিনি কিন্তু রাজস্থানের উপমুখ্যমন্ত্রী।
২০১৯ সালে কর্নাটকের বিজেপি অনন্ত কুমার হেগড়ের দাবি, তাজমহলের মূল মালিক নাকি রাজস্থানের রাজা জয় সিং। অনন্ত কুমার আর দাবি করেন যে, মোগল সম্রাট শাহজাহান এটা কিনে নেন। তারও আগে ১৯৬৫ সালে পুরুষোত্তম নাগেশ ওক (পিএন ওক) একটি পুস্তক লেখেন। বইটির নাম ‘তাজমহল ইজ অ্যা রাজপুত প্যালেস।’ মিস্টার পিএন ওক ভারতীয় সেনাবাহিনীতে চাকরি করতেন। সেখানে তিনি প্রচার বিভাগে ছিলেন। তাই তিনি পেশাভিত্তিক অভ্যাস তাজমহল নিয়ে অনেক কল্পিত প্রচারের সামনে আনেন। ১৯৬৪ সালে পিএন ওক ‘ইতিহাস পুনর্লিখন ইনস্টিটিউট’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। যদিও বিদেশি অনেক প্রতিষ্ঠান ওকের কল্পিত যুক্তি খণ্ডন করেন। তবুও ‘দ্য তাজ স্টোরি’র অভিনেতা পরেশ রাওয়ালের মতো তারকা অভিনেতার ওকের কল্পিত তথ্য অনেক কাজে লেগেছে। জাইলস টিলোটসেনের মতো বিশ্বনন্দিত প্রত্নতাত্ত্বিক পণ্ডিত মনে করেন, তাজমহল নির্মাণের কারিগরি ও নান্দনিক ধরন মোগল-পূর্ব আমলেও ছিল। তিনি এ ব্যাপারে সেরা বিশেষজ্ঞ বলে মনে করা হয়। এর পরও পিএন ওক এ বিষয়ে আরও একটি পুস্তক লেখেন। সেই পুস্তকটির নাম ‘তাজমহল : টু স্টোরি’। ২০০২ সালে ভারতের সুপ্রিমকোর্টে আনও একটি মামলা হয়। আদালত সেটাও অগ্রাহ্য করেন। এতকিছুর পরও বিজেপি-আরএসএসসহ সঙ্ঘ পরিবার তাজমহল ইস্যু নিয়ে সরে আসছে না। বিজেপির হাতে কোনো ইস্যু নেই। বাবরি মসজিদ-রামমন্দির ইস্যু, রাম-রথযাত্রা, গুজরাট গণহত্যা, তার আগে মুম্বাই দাঙ্গা, ভাগলপুর, সুরাট, আহমেদাবাদ এমনকি ১৯৮২ আসামের নেলি গণহত্যা তাদের রাজনৈতিক? স্বার্থসিদ্ধিকে রক্ষা করেছে। তিন-তিনবার মোদি ক্ষমতায় এসেছে। ভারতের আর্থিক পরিস্থিতি আজ দেউলিয়া হয়ে গেছে। সব রাষ্ট্রায়ত্ত লাভজনক সংস্থা এখন আদানি-আম্বানি দেশি-বিদেশি করপোরেটদের কাছে চলে গেছে। ২০২৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে তাজমহল-শিবমন্দির একমাত্র হাতিয়ার? মোদিজির কাছে। মোদিজি ভারতে তৈরি? করেছেন করপোরেট? সাম্প্রদায়িকতা। ইতোমধ্যেই মোগল সম্রাট শাহজাহান নির্মিত লালকেল্লা চলে গেছে বেসরকারি হাতে। বলা ভালো আদানি-আম্বানিদের হাতে। লালকেল্লার ঐতিহাসিক লাহোর গেট আর নেই। তাই তাজমহল হলো মোদির নিশানা। তাজমহল হলো মোদির মোক্ষম টার্গেট। তাজমহল হলো দাবার ঘুঁটি। ইংরেজিতে একটা কথা? রয়েছে। আর তা হলো ‘অ ঝঃধঃবংসধহ ঃযরহশং ভড়ৎ ঃযব হধঃরড়হ, অ চড়ষরঃরপরধহ ঃযরহশং ভড়ৎ ঃযব হবীঃ বষবপঃরড়হ’. অর্থাৎ একজন রাষ্ট্রনায়ক চিন্তা করেন জাতি বা দেশের কথা, একজন রাজনীতিবিদ চিন্তা করেন আগামী নির্বাচনের কথা। মোদিজির ২০২৯-এর মোক্ষম দাওয়াই? স্মৃতি-সমাধি তাজমহল। টার্গেট তাজমহল। জানি না বিশ্বজনমত কী অবস্থান নেবে। ভারতীয় জনমত কী করবে। এ দেশেও নরেন্দ্র দাভোলকর, গোবিন্দ পানসারে, কালবুর্গী বা গৌরী লঙ্কেশরা আজও রয়েছেন। হয়তো তারাও চুড়ি পরে বসে থাকবেন না।
মোহাম্মদ সাদউদ্দিন : কলকাতার কলামিস্ট, প্রাবন্ধিক ও কবি
মতামত লেখকের নিজস্ব