চসিকে বছরজুড়ে মেয়র ও প্রধান নির্বাহীর দ্বন্দ্ব
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) মেয়রের সঙ্গে আমলাতন্ত্রের বিরোধ নতুন নয়। বর্তমান মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেনের সঙ্গেও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলামের দ্বন্দ্বের কারণে চসিকের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড শিকেয় উঠেছে। সিটি করপোরেশনের জন্য বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) ৮০০ কোটি টাকার প্রকল্প বরাদ্দ থাকলেও দুই প্রধান ব্যক্তির বিরোধে গত এক বছরে এক টাকারও কাজ হয়নি।
মেয়র ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার বিরোধ এমন পর্যায়ে উঠেছে যে, বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী এবং চসিকের বিএনপিপন্থি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দুই দফা সভা-সমাবেশ করেছেন। তাঁরা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলামের অপসারণ ও তাঁকে দুর্নীতিবাজ আখ্যা দিয়ে বিচার দাবি করেছেন। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার তিনি নগর ভবনে যান কাজে যোগ দিতে। কিন্তু ওই দিন একদল লোক ‘জিয়ার সৈনিক এক হও’ স্লোগান দিয়ে শেখ তৌহিদকে ঠেকানোর ঘোষণা দেন।
এ বিষয়ে স্বয়ং মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন আমাদের সময়কে বলেন, তিনি (প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা) বিগত মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীর সঙ্গে কাজ করেছেন। রেজাউল করিম চৌধুরী দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত। এ অভিযোগ থেকে তৌহিদ সাহেবও মুক্ত নন। আমি তাঁকে দুর্নীতির জবাব দিতে শোকজ করেছি। এখনও তিনি জবাব দেননি। মেয়র বলেন, তৌহিদ সাহেবের পরিবার ঢাকায় থাকে। তিনিও হরহামেশা ঢাকায় যান। তাঁকে দিয়ে চসিকের কাজ হচ্ছে না।
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট আন্দোলন-পরবর্তী গণঅভ্যুত্থানে হাসিনা সরকারের পতনের পর আদালতের আদেশে মেয়র পদে আসীন হন চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির সাবেক সভাপতি ডা. শাহাদাত হোসেন। তিনি গত বছরের ৩ নভেম্বর মেয়র হিসেবে শপথ নেন। তার আগে নির্বাচনী ট্রাইব্যুনাল ১ অক্টোবর ডা. শাহাদাতকে মেয়র ঘোষণা করেন। ৮ অক্টোবর সরকার প্রজ্ঞাপন জারি করে। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর রেজাউল করিম চৌধুরী অনুপস্থিত থাকলেও সরকারের এডিপির প্রায় ১ হাজার ৭০০ কোটি টাকার কাজ চলমান ছিল। ডা. শাহাদাত হোসেন দায়িত্ব নেওয়ার পর অবশিষ্ট ৮০০ কোটি টাকার কাজ শুরুর দায়িত্ব পড়ে তার ওপর। আর তখনই বিরোধ বাধে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলামের সঙ্গে। শেখ তৌহিদ সরকারের একজন যুগ্ম সচিব। তিনি প্রেষণে এসে দায়িত্ব পালন করছেন। ২০২৩ সালের ২২ জানুয়ারি তিনি এ পদে যোগ দেন।
আরও পড়ুন:
আকতার পারভেজ সর্বোচ্চ ভোটে সিএসই পরিচালক
চসিক সূত্র জানায়, ডা. শাহাদাত দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথম দফায় প্রায় ৮০ কোটি টাকার ১০টি কাজের দরপত্র আহ্বান করেন। কিন্তু কাজগুলোর দরপত্র মূল্যায়নসহ নানা রকম যাচাই বাছাইয়ের নামে তিন মাস চলে যায়। এর ফলে নতুন করে দরপত্র আহ্বান করতে হয়। এতে চসিক মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলামের ওপর ক্ষুব্ধ হন। পরে প্রায় ১০০ কোটি টাকার আরও ১৩টি প্রকল্পের দরপত্র দেওয়া হয়। সেগুলো বর্তমানে মূল্যায়ন পর্যায়ে রয়েছে। সর্বশেষ পর্যায়ে নতুন করে আরও ১০০ কোটি টাকার ১৪টি প্রকল্পের দরপত্র দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সরকারি ক্রয়বিধি (পিপিআর) ২০২৫ চালু হবার পর এই দরপত্র আর কোনো কাজে আসেনি।
চসিকের প্রধান প্রকৌশলী আনিসুর রহমান আমাদের সময়কে বলেন, আমাদের এই ১০০ কোটি টাকার উন্নয়ন কাজের জন্য নতুন করে দরপত্র দিতে হবে।
খোঁজ নিয়ে গেছে, নানা ধরনের আমলাতান্ত্রিক প্রতিবন্ধকতার কারণে গত এক বছরে ডা. শাহাদাত এডিপির কোনো প্রকল্পই বাস্তবায়ন করতে পারেননি। এমনকি নগরীর বাদশা মিয়া সড়কে তাঁর বাসার সামনের সড়কটি নতুন করে কার্পেটিং করার কাজটিও আগের মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীর আমলে নেওয়া। এর মধ্যে নিজস্ব তহবিল থেকে কিছু কাজ করা হয়েছে। কোভিড প্রকল্পের আওতায়ও চসিকের কিছু উন্নয়ন কাজ হয়েছে, যা ১০০ কোটি টাকার বেশি নয়।
আরও পড়ুন:
বৃহত্তম হিমশৈল
এরই মধ্যে মেয়র ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার বিরোধ এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে, গত ১ জুলাই কানাডা সফর শুরুর আগে ডা. শাহাদাত হোসেন স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়ে প্রধান নির্বাহীকে প্রত্যাহার করতে বলেন। কিন্তু ওই চিঠি মন্ত্রণালয় আমলে নেয়নি। মেয়র কানাডা থেকে দেশে ফিরে গৃহকর অ্যাসেসমেন্টের ৪২ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ পান। এ নিয়ে তিনি প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে শোকজও করেন।
জানতে চাইলে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম আমাদের সময়কে বলেন, এই ঘটনা যখন ঘটে, তখন আমি দায়িত্বে ছিলাম না। ঘটনা নজরে আসার পর মেয়র মহোদয় অতিরিক্ত জেলা জজ পদমর্যাদার চসিক আইন কর্মকর্তাকে দিয়ে কমিটি গঠন করে দিয়েছেন। আর গৃহকর অ্যাসেসমেন্টের টাকা আত্মসাৎ হয়নি। এটা ধরা পড়ার পর আদায়ের সুযোগ আছে। তবে অ্যাসেসমেন্টের ১৪ শতাংশ পাবে চসিক। পুরোটা তো নয়। তিনি বলেন, সরকার ৩৮ জন যুগ্ম সচিবকে প্রশিক্ষণে ডেকেছিল। দেড় মাস প্রশিক্ষণ শেষে সবাই নিজ কার্যালয়ে যোগ দেন। আমি যোগ দিতে চাইলে মেয়র মহোদয় আমার যোগদানপত্র গ্রহণ করেননি। বিষয়টি আমি মন্ত্রণালয়ে জানিয়েছি। এখন সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব মন্ত্রণালয়ের।