দুর্নীতি অনুসন্ধানে কাজে লাগানো হবে দুদককে
দেশের শিক্ষা খাতে দীর্ঘদিন ধরে গড়ে ওঠা অনিয়ম ও দুর্নীতির শিকড় ছড়িয়ে গেছে বেসরকারি এমপিওভুক্ত স্কুল-কলেজেও। এবার সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বেসরকারি স্কুল-কলেজেও দুর্নীতি অনুসন্ধানে অভিযান চালানোর পরিকল্পনা করছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ ক্ষেত্রে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সরকারি প্রতিষ্ঠানের মতো বেসরকারি স্কুল-কলেজের দুর্নীতিও অনুসন্ধান করবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে এমন নির্দেশনা এসেছে, যাতে নির্বাচনের আগেই এই অভিযান শুরু করা যায়।
মন্ত্রণালয়ের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে আমাদের সময়কে বলেন, এখন পর্যন্ত দুদক কেবল সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতেই অভিযান চালায়। কিন্তু বেসরকারি এমপিওভুক্ত স্কুল-কলেজেও নানা অনিয়ম চলছে। শিক্ষক নিয়োগে ঘুষ, এমপিও অনুমোদনে দুর্নীতি, অডিট রিপোর্টে গড়িমসিÑ সবকিছু মিলিয়ে একটি সমান্তরাল অনিয়মের সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে। এ উদ্যোগটি এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। তবে জাতীয় নির্বাচন হওয়ার আগে অভিযান শুরু করা গেলে শিক্ষা খাতে একটি বড় বার্তা যাবে। নির্বাচনের পর এই ধরনের পদক্ষেপ বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে পড়তে পারে।
স্থায়ী সংস্কার দরকার : ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) এক গবেষণায় উঠে এসেছে, দেশের স্কুল-কলেজ পর্যায়ে ভর্তি, এমপিওভুক্তি, শিক্ষক নিয়োগ, এমনকি পরীক্ষার ফলাফলের ক্ষেত্রেও অনিয়মের জাল ছড়িয়ে আছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোয় এ অনিয়ম আরও গভীরে প্রোথিত। কারণ, এসব প্রতিষ্ঠানের আর্থিক ও প্রশাসনিক স্বচ্ছতা খুবই সীমিত। শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. মনজুর আহমদ
মনে করেন, আমাদের শিক্ষাপ্রশাসনে জবাবদিহির ঘাটতি ভয়াবহ। সরকারি বা বেসরকারি- উভয় ক্ষেত্রেই দুর্নীতি একপ্রকার নীরব সংস্কৃতি হয়ে উঠেছে। শুধু অভিযান নয়, প্রশাসনিক কাঠামোয় স্থায়ী সংস্কার দরকার।
আরও পড়ুন:
হরতাল-অবরোধে শীতের পোশাক ব্যবসায় মন্দা
ডিআইএ-কাগজে সক্রিয়, বাস্তবে নিস্তেজ : শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তদারকি সংস্থা ‘দপ্তর পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর’ (ডিআইএ) দীর্ঘদিন ধরে রয়েছে কার্যকারিতার সংকটে। সংস্থাটির নিজস্ব প্রতিবেদন অনুযায়ী, অনুমোদিত পদের প্রায় ৬০ শতাংশ এখনও শূন্য। ফলে অধিকাংশ বিদ্যালয়-ক?লেজ দীর্ঘদিন ধরে কোনো নিরীক্ষার মুখই দেখেনি। একইসঙ্গে ডিআইএ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ঘুষ ও অনিয়মের অভিযোগও একাধিকবার উঠেছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন সাবেক সচিব বলেন, যে সংস্থা নিজেই দুর্নীতির অভিযোগে জর্জরিত, তার পক্ষে অন্যের দুর্নীতি ধরার মতো নৈতিক অবস্থান তৈরি হয় না।
টিআইবির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পরিদর্শন রিপোর্ট অনেক সময় ‘সংশোধনের সুপারিশে’ থেমে যায়- শাস্তি বা জবাবদিহির কোনো ধাপ অনুসরণ করা হয় না। এতে দুর্নীতিবাজরা আরও সাহস পায়।
আরও পড়ুন:
আকতার পারভেজ সর্বোচ্চ ভোটে সিএসই পরিচালক
সীমিত অভিযান, ক্ষণস্থায়ী প্রভাব : ২০১৮ সালে দুদক সরকারি স্কুল-কলেজে কোচিং ব্যবসা ও নিয়োগ বাণিজ্য নিয়ে সীমিত পরিসরে অভিযান চালিয়েছিল। কিছু শিক্ষক ও কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্তও করা হয়। কিন্তু নিয়মিত তদারকির অভাবে সেই উদ্যোগের ধারাবাহিকতা বজায় থাকেনি। এ ছাড়া ২০২৫ সালের শুরুতেও রাজশাহী ও খুলনা অঞ্চলের কয়েকটি এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানে ভুয়া বেতন বিল এবং ‘ডুপ্লিকেট এমপিও’ সংক্রান্ত অভিযোগে দুদক অভিযান চালায়। কিছু অনিয়ম ধরা পড়লেও মামলা প্রক্রিয়া জটিলতায় পড়ে যায়।
শিক্ষাবিদরা বলছেন, এবার যদি দুদক সত্যিই বেসরকারি এমপিওভুক্ত স্কুল-কলেজে অভিযান চালায়, এটি হবে এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপ। কারণ এতদিন পর্যন্ত এসব প্রতিষ্ঠান ছিল সরকারের নজরদারির বাইরে।
অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. জিয়াউল কবির দুলু আমাদের সময়কে বলেন, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষক নিয়োগ থেকে শুরু করে পরিচালনা পর্ষদ গঠন পর্যন্ত সর্বত্র দলীয় প্রভাব কাজ করে। যদি দুদক নিরপেক্ষভাবে অনুসন্ধান চালাতে পারে, তাহলে শিক্ষার মানোন্নয়নে বড় পরিবর্তন আসতে পারে। তবে সতর্ক করে দিয়ে তিনি বলেন, এই অভিযান যেন ‘দেখানোর মতো’ না হয়। কারণ অতীতে আমরা দেখেছি, রাজনৈতিক সময়সূচির সঙ্গে মেলাতে গিয়ে অনেক অভিযান শুরু হয়, কিন্তু পরে ধামাচাপা পড়ে যায়।
আরও পড়ুন:
বৃহত্তম হিমশৈল
অভিভাবক প্রতিনিধি সংগঠনগুলোর দাবি, এসব অভিযান যেন জনসম্মুখে স্বচ্ছভাবে পরিচালিত হয় এবং এর ফল নিয়মিতভাবে প্রকাশ করা হয়। কারণ দুর্নীতি শিক্ষার শেকড়কে দুর্বল করে। শিক্ষক, অভিভাবক, শিক্ষার্থীÑ তিন পক্ষই এর ভুক্তভোগী।