আইএমএফের কিস্তি আটকে যাচ্ছে রাজস্ব ঘাটতিতে
চলমান ঋণ কর্মসূচির ষষ্ঠ কিস্তি ছাড়ের আগে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রতিনিধি দল বুধবার ঢাকায় আসছে। ২৯ অক্টোবর থেকে ১৩ নভেম্বর পর্যন্ত তারা সরকারের বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে বৈঠক করে ঋণের শর্ত বাস্তবায়নের অগ্রগতি পর্যালোচনা করবে। এ সময়ে তাদের দেওয়া শর্তগুলো পর্যবেক্ষণ করবে। তবে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হওয়ায় ঋণ ছাড় নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।
আইএমএফের গবেষণা বিভাগের উন্নয়ন সামষ্টিক অর্থনীতি শাখার প্রধান ক্রিস পাপাজর্জিওর নেতৃত্বাধীন দলটি শুরু থেকে পঞ্চম কিস্তির অর্থছাড়ের সঙ্গে সম্পর্কিত শর্ত পূরণের অগ্রগতি পর্যালোচনা করবে। এ জন্য দলটি বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), বিদ্যুৎ বিভাগ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর সঙ্গে বৈঠক করবে। খবর অর্থ বিভাগ সূত্রের।
অর্থ বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, প্রতিনিধি দল ২৯ অক্টোবর অর্থ বিভাগের সঙ্গে এবং পরের দিন শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠক করবে। ২ নভেম্বর থেকে ৬ নভেম্বর পর্যন্ত অর্থ মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন বিভাগের সঙ্গে বৈঠক করবে। ১১ নভেম্বর জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠক করার পরিকল্পনা রয়েছে। এ ছাড়া ১২ নভেম্বর অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠক শেষে যৌথ প্রেস ব্রিফিং করার কথা রয়েছে।
জানা গেছে, বাংলাদেশের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২৩ সালের ৩০ জানুয়ারি আইএমএফ ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন করে। এরপর ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রথম কিস্তির ৪৭ কোটি ৬৩ লাখ ডলার, ডিসেম্বরে দ্বিতীয় কিস্তির ৬৮ কোটি ১০ লাখ ডলার, ২০২৪ সালের জুনে তৃতীয় কিস্তির ১১৫ কোটি ডলার এবং ২০২৫ সালের জুনে চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির ১৩৩ কোটি ডলার পেয়েছে বাংলাদেশ।
আরও পড়ুন:
একে আবদুল মোমেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী
সাত কিস্তিতে সাড়ে ৩ বছরে আইএমএফ ৪৭০ কোটি ডলার দেবে বলেছিল। আইএমএফ থেকে মোট পাওয়া গেছে ৩৬৪ কোটি ডলার। বাকি আছে ১০৬ কোটি ডলার। এর মধ্যে গত জুন মাসে আইএমএফের পর্ষদ বাংলাদেশের ঋণ কর্মসূচির মেয়াদ বাড়িয়েছে ছয় মাস এবং বাড়তি ৮০ কোটি ডলারও যুক্ত করেছে। কিস্তির সংখ্যাও এখন ৭ থেকে বেড়ে আটটি হয়েছে। ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ কর্মসূচি বেড়ে এখন ৫৫০ কোটি ডলারের হয়েছে। ফলে মোট পাওয়ার বাকি এখন ১৮৬ কোটি ডলার। আর নতুন সময়সীমা অনুযায়ী ঋণ কর্মসূচির মেয়াদ শেষ হবে ২০২৭ সালের জানুয়ারিতে।
আইএমএফের এবারের প্রতিনিধি দল সংস্থাটির ‘পরিমাণগত কর্মক্ষমতা মানদণ্ড’ (কোয়ান্টিটেটিভ পারফরম্যান্স ক্রাইটেরিয়া বা কিউপিসি) পূরণ নিয়ে বেশি আলোচনা করবে বলে জানা গেছে। কিউপিসি হচ্ছে আইএমএফের বাধ্যতামূলক শর্ত। গত মে মাসে কিউপিসির কিছু শর্ত যুক্ত হয়েছে। এগুলো হচ্ছে বিদেশি ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে সীমা নির্ধারণ, জ্বালানি ও সার আমদানির বকেয়া পরিশোধ এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ। এ তালিকায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংরক্ষণের শর্তও আছে। এসব শর্ত পূরণ না হলে আইএমএফ পরের কিস্তি দেয় না। তবে আইএমএফের নির্বাহী পর্ষদ চাইলে কোনো কোনো শর্তের বিষয়ে পূর্ণ বা আংশিক অব্যাহতি দিতে পারে। আইএমএফ বলেছে, চলতি অর্থবছরে ৮৪৪ কোটি ডলারের বেশি বিদেশি ঋণ নিতে পারবে না বাংলাদেশ। আইএমএফ তিন মাস পরপর বিদেশি ঋণ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করবে।
এদিকে আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী, গত জুন শেষে বাংলাদেশের নিট আন্তর্জাতিক রিজার্ভ (এনআইআর) থাকার কথা ১ হাজার ৭৪০ কোটি ডলার। তার বিপরীতে জুন শেষে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেশি ছিল। আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী, জ্বালানি ও সার আমদানির বকেয়া পরিশোধের লক্ষ্যমাত্রাও সন্তোষজনক পর্যায়েই আছে। দুশ্চিন্তা শুধু রাজস্ব আদায় নিয়ে। শর্ত অনুযায়ী, গত জুন পর্যন্ত ৪ লাখ ৪৩ হাজার ৫৩০ কোটি টাকার রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। এর বিপরীতে এনবিআর আদায় করেছে ৩ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা।
জানা গেছে, আগের হিসাব অনুযায়ী ষষ্ঠ ও সপ্তম কিস্তিতে বাংলাদেশের পাওয়ার কথা ৫৩ কোটি ডলার করে। ষষ্ঠ কিস্তি পাওয়ার কথা আগামী ডিসেম্বরে। বড়দিন ঘিরে ডিসেম্বরে ওয়াশিংটনে লম্বা ছুটি থাকে। ফলে আইএমএফের নির্বাহী পর্ষদের বৈঠক ডিসেম্বরে হওয়ার সম্ভাবনা কম। এটা চলে যাবে আগামী বছরের জানুয়ারিতে। তবে এরই মধ্যে বদলে গেছে কিস্তির পরিমাণ। ষষ্ঠ ও সপ্তম কিস্তিতে বাংলাদেশ পাবে ৪৩ কোটি ডলার করে। শেষ কিস্তি নির্ধারিত হয়েছে ১০০ কোটি ডলার, যা পাওয়ার কথা ২০২৭ সালের জানুয়ারিতে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণের ষষ্ঠ কিস্তি এ বছরের শেষ নাগাদ নাও আসতে পারে। কারণ, দাতা সংস্থাটি সংস্কার কর্মসূচির ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করতে নতুন রাজনৈতিক সরকারের সঙ্গে কাজ করতে চায়। গত ১৩ থেকে ১৮ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটনে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের বার্ষিক সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে বাংলাদেশের একটি প্রতিনিধি দল অংশ নেয়। এ সময় অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ জানিয়েছেন, পরের কিস্তি মার্চ বা এপ্রিলে আসতে পারে। তবে এটা বাংলাদেশের জন্য কোনো নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে না, বরং ভালোই হবে।