তদবির রাজনীতি আর দ্বন্দ্বে অচল মাউশি

নতুন দক্ষ ডিজি খুঁজছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়

এম এইচ রবিন
২৭ অক্টোবর ২০২৫, ০৯:০৭
শেয়ার :
তদবির রাজনীতি আর দ্বন্দ্বে অচল মাউশি

মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) শিক্ষা প্রশাসনের অন্যতম কেন্দ্রীয় সংস্থা। বর্তমানে এটি কার্যত অচলাবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। মহাপরিচালক (ডিজি) নিয়োগ নিয়ে শিক্ষা ক্যাডারের অভ্যন্তরে তীব্র দ্বন্দ্ব, তদবির এবং ত্রিমাত্রিক রাজনৈতিক প্রভাবের জটিলতা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, সংস্থাটির কার্যক্রম থমকে আছে প্রায় পুরোপুরি।

মাউশির ডিজি পদে নিয়োগের জন্য গতকাল থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রার্থীদের সাক্ষাৎকার নেওয়া শুরু করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। সূত্র জানায়, শিক্ষা ক্যাডারের ১৪তম ও ১৬তম ব্যাচের মোট ৬৩ জন কর্মকর্তা এই পদে নিয়োগের জন্য জীবনবৃত্তান্ত জমা দিয়েছেন। সার্চ কমিটির তত্ত্বাবধানে পর্যায়ক্রমে তাঁদের সাক্ষাৎকার নেওয়া হবে। আরও জানা গেছে, প্রশাসনিক দক্ষতা, একাডেমিক যোগ্যতা ও নৈতিক মানদণ্ড এই তিনটি দিক বিবেচনায় রেখেই মাউশির পরবর্তী ডিজি নির্বাচন করা হবে।

ডিজি পদটি শুধু প্রশাসনিক নয়, এটি নীতিনির্ধারণ ও শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের হৃদয়স্থল। দেশব্যাপী মাধ্যমিক ও কলেজ পর্যায়ের শিক্ষক নিয়োগ, এমপিওভুক্তি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন, পরীক্ষার ব্যবস্থাপনা সব ক্ষেত্রেই এই পদধারীর প্রভাব নির্ধারক। ফলে এই পদে বসার প্রতিযোগিতা এখন এক প্রকার ক্ষমতার লড়াইয়ে রূপ নিয়েছে।

অধ্যাপক ড. আবুল কালাম আজাদ খান দায়িত্বে থাকতেই নতুন ডিজি নিয়োগের জন্য গত ৭ অক্টোবর বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এরপর তিনি ব্যক্তিগত কারণ উল্লেখ করে পদত্যাগপত্র দেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে। গত ১৪ অক্টোবর দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় অধ্যাপক ড. আবুল কালাম আজাদ খানকে। এর আগে গত আগস্টে রাজনৈতিক পালাবদলের পর মাত্র দুই মাসে তিনজন ডিজি পরিবর্তন করা হয়, যা শিক্ষা প্রশাসনের ইতিহাসে নজিরবিহীন।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানান, এই অস্থিরতার পর এবার মন্ত্রণালয় পদটি রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগের মতো পদ্ধতি অনুসরণ করে উন্মুক্তভাবে আবেদন আহ্বান করা হয়। তাতে ৬৩ জন শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তা আবেদন করেছেন, যার মধ্যে রয়েছেন কলেজের অধ্যক্ষ, প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ও মাউশির প্রভাবশালী কর্মকর্তারাও।

মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) ও সার্চ কমিটির সদস্য মো. মজিবর রহমান আমাদের সময়কে বলেন, ‘একাডেমিক ও প্রশাসনিক দক্ষতা যাচাই করে যোগ্য ও নিরপেক্ষ প্রার্থীকে সুপারিশ করার লক্ষ্য নিয়েই আমরা কাজ করছি।’

তবে পর্দার আড়ালে চলছে তদবিরের রমরমা। জানা গেছে, ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান ড. খন্দকার এহসানুল কবির বিএনপি হাই কমান্ডের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন। মাউশির মনিটরিং অ্যান্ড ইভাল্যুয়েশন উইংয়ের পরিচালক কাজী মো. আবু কাইয়ুম শিশির একসময় ছাত্রদলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তিনিও সক্রিয় তদবির চালাচ্ছেন। অন্যদিকে কলেজ ও প্রশাসন শাখার পরিচালক অধ্যাপক বি এম আব্দুল হান্নান বর্তমানে ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন এবং স্থায়ী নিয়োগের দৌড়েও আছেন।

তাঁদের পাশাপাশি আরও কয়েকজন কর্মকর্তা- পরিকল্পনা ও উন্নয়ন উইংয়ের পরিচালক ড. এ কিউ এম শফিউল আজম, প্রশিক্ষণ শাখার পরিচালক মো. সাঈদুর রহমান, সরকারি তিতুমীর কলেজের অধ্যক্ষ ড. ছদরুদ্দীন আহমদ, সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. কাকলী মুখোপাধ্যায় এবং মাউশির মাধ্যমিক শাখার পরিচালক ড. খান মইনুদ্দিন আল মাহমুদ সোহেল ডিজি পদে আগ্রহী। তবে তাঁদের মধ্যে কয়েকজনের চাকরির মেয়াদ আগামী ডিসেম্বরেই শেষ হচ্ছে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘মাউশির ভেতরে চলমান অনিয়ম, দুর্নীতি ও রাজনৈতিক প্রভাব শিক্ষাব্যবস্থার শৃঙ্খলা নষ্ট করছে। এই পদে নিরপেক্ষ ও দক্ষ নেতৃত্ব না এলে শিক্ষক-শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে প্রশাসনিক কাঠামো পর্যন্ত হতাশা বাড়বে।’

বিশেষজ্ঞদের মতে, মাউশি ডিজি পদের স্থায়ী নেতৃত্বে অনিশ্চয়তা ও রাজনৈতিক টানাপড়েন শিক্ষাব্যবস্থায় অস্থিরতা বাড়াচ্ছে। শিক্ষা বিশ্লেষকরা বলছেন, এই পদে নিয়োগ কেবল প্রশাসনিক দায়িত্ব নয়- এটি শিক্ষা নীতির দিকনির্দেশনা নির্ধারণ করে। রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত, দক্ষ এবং নৈতিক নেতৃত্ব ছাড়া শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার সম্ভব নয়।

এখন প্রশ্ন একটাই- কে হচ্ছেন মাউশির পরবর্তী ডিজি? না কি ভারপ্রাপ্ত অধ্যাপক বি এম আব্দুল হান্নানের হাতেই চলবে সংস্থাটি? উত্তর এখনও অনিশ্চিত। তবে এটা নিশ্চিত যে, ডিজি পদে স্থিতিশীলতা না আসা পর্যন্ত মাউশির কার্যক্রমে অচলাবস্থা কাটবে না। ফলে এই পদে নিয়োগ শুধু একটি প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নয়, এটি দেশের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার ভবিষ্যৎ শৃঙ্খলা, স্বচ্ছতা ও নীতিনির্ধারণের অন্যতম পরীক্ষা হয়ে দাঁড়িয়েছে।