বুদ্ধিজীবীগণ, নিরপেক্ষতার মুখোশটা রাখুন

নাহিদ হাসান
২৭ অক্টোবর ২০২৫, ০৭:২৮
শেয়ার :
বুদ্ধিজীবীগণ, নিরপেক্ষতার মুখোশটা রাখুন

বুদ্ধিজীবী কাকে বলে, এটা আমরা অনেকেই জানি না। কিন্তু না জানলেও, বুদ্ধিজীবী বলতে আবছা একটা ধারণা আছে সবারই। কেমন সেটা? বুদ্ধিজীবীর কাছে মানুষ কী চায়, সেটা দিয়েই গণধারণাটা টের পাওয়া যায়। মানুষ চায়, বুদ্ধিজীবীরা তাদের খুশি করার জন্য কথা বলবেন না, কারণ তারা ভোটের কারবারি নন। শ্রোতা বা পাঠকের অপছন্দ ও কঠিন হলেও সত্যটাই তারা বলবেন। আর বুদ্ধিজীবীরা যেহেতু সত্য বলেন, তাই তারা কোনো পার্টির অধীন থাকতে চাইলেও পারেন না। এমনকি বুদ্ধিজীবীদের এত কঠিন সত্য বলতে হয়, সেটা তার নিজ জন্মভূমি বা ধর্মীয় বিশ্বাসের বিরুদ্ধেও যেতে পারে। বুদ্ধিজীবীরা বৈষয়িক নন। এ জন্য লোকেরা বুদ্ধিজীবীদের পাগলও বলে।

বুদ্ধিজীবীর কাজ হলো এমন কাজ, যেখানে মূল ভূমিকা পালন করে চিন্তা, যুক্তি, বিশ্লেষণ ও সৃজনশীলতা। এটি শারীরিক শ্রমের পরিবর্তে মানসিক শ্রম বা মস্তিষ্কের পরিশ্রমের ওপর নির্ভরশীল। তারা এই কাজের মাধ্যমে সমাজকে পথ দেখান। জুলাই অভ্যুত্থানে সলিমুল্লাহ খান ও আনু মুহাম্মদরা যখন হাসিনার উন্নয়নের বয়ান প্রত্যাখ্যান করে তার পদত্যাগ দাবি করেন, তখনই আসলে হাসিনার পতনের ক্ষণগণনা শুরু হয়।

পার্টি গঠনের পেছনে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা থাকে। সেটা কমিউনিস্ট পার্টি হোক আর পিপলস পার্টি হোক। এ কারণেই কৃষক-প্রজা পার্টি করতে গিয়ে শেরেবাংলা একে ফজলুল হককে কাজী নজরুল ইসলামকে সম্পাদক বানিয়ে নবযুগ, লাঙ্গল পত্রিকা আর আওয়ামী লীগ গঠনের সঙ্গে সঙ্গেই মওলানা ভাসানীকে ইত্তেফাক পত্রিকার জন্ম দিতে হয়। জনগণকে সংগঠিত করতে মতাদর্শ লাগে, আর মতাদর্শ নির্মাণ করেন বুদ্ধিজীবীরাই।

কেউ কেউ বলেন, লীগের শাসন আমাদের সবকিছুর স্ট্যান্ডার্ড লো করে দিয়েছে। সবচেয়ে নিচে নেমেছে বুদ্ধিজীবিতার মান। এমন সব লোক বুদ্ধিজীবীর পরিচয় পেয়েছেন যারা আসলে ক?্যানভাসার। কিন্তু কেন? এই প্রজন্ম যখন তৈরি হয়েছে, তখন শিক্ষার দশা বেহাল। বইয়ের বদলে টেলিভিশন ভূমিকা নিয়েছে। টেলিভিশনের তারকারাই বুদ্ধিজীবীর ভূমিকা নিয়েছেন। এরপর ফেসবুক এসে ভাসিয়ে দিয়েছে সব। এখন থার্ডক্লাস ইউনিভার্সিটি থেকে পাস দেওয়া ইউটিউবারের সস্তা আলাপই স্ট্যান্ডার্ড। কেন এটা ঘটল?

জনগণ যেমন তাদের প্রত্যাশাও তেমন। শিক্ষার মানের সঙ্গে শিক্ষার্থীর মনও গড়ে ওঠে। গড়ে ওঠে জাতির মনন। স্বাধীন বাংলাদেশে নতুন যে বিত্তবান শ্রেণি লুটপাটের মধ্যে জন্ম নিল, তাদের হাতে প্রথম ধ্বংস হলো শিক্ষা। ’৭২ সালের পরীক্ষা দিয়ে শুরু। হাসিনা আমলে তা চূড়ান্ত রূপ নিল।

লিখলেই পাস হয়, এমন শিক্ষার্থীদের জন্য গড়ে উঠল ব্যাঙের ছাতার মতো বিশ্ববিদ্যালয়। এই শিক্ষার্থীরা শিক্ষাটা পেল না কিছুই, কিন্তু এমএ পাসের অহংকারটা পেল ষোলো আনা। আর ফেসবুক দিল তাদের চিন্তা প্রকাশের অবারিত আকাশ। ফলে সর্বস্তরে এক প্রলয়ঙ্করী দশা নেমে এসেছে।

দুই.

এনসিপি নতুন পার্টি হিসেবে সেখানে তাত্ত্বিক নেতা থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। একঝাঁক বুদ্ধিজীবী আর সংগঠকের মিশেলে গড়ে উঠবে। এই বুদ্ধিজীবী যারা যাবেন তারা মধুর লোভে যাবেন না। কারণ যে পার্টি ক্ষমতায় যাবে কিনা ঠিক নেই, সেই পার্টিতে বুদ্ধিজীবীদের যোগদান, এটা তাদের লড়াকু বৈশিষ্ট্যেরই প্রমাণ। স্বাধীন বাংলাদেশে জাসদকেও আহমদ ছফাসহ একঝাঁক বুদ্ধিজীবীর সহযোগিতা নিতে হয়েছে।

কিন্তু বিএনপির বেলায় এটা সত্য হবে না। বিএনপিতে যে বুদ্ধিজীবীরা যোগ দেবেন, তারা ক্ষমতার মধু পেতেই দেবেন। যেভাবে বিএনপি পদ বিলাচ্ছে, তাতে ভবিষ্যতে আর বুদ্ধিজীবী খুঁজে পাওয়া যাবে না। কিন্তু বিএনপির বুদ্ধিজীবী লাগবে। বিএনপির অপকর্মের সাফাই গাওয়ার জন্য নিরপেক্ষ ঢঙে কথা বলার লোক লাগবে।

লীগ কিন্তু এভাবে কাছা মেরে বুদ্ধিজীবীদের পদ বিলায়নি। তারা বুদ্ধিজীবীদের প্লট দিয়েছে, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে রাজনৈতিক নেতার চেয়ে অধিক গুরুত্ব দিয়েছে। সমাজ দেখেছে, দলীয় লোক না হয়েও একজন বুদ্ধিজীবী এত মর্যাদাবান হতে পারেন। এতে বুদ্ধিজীবীদের একটা নিরপেক্ষ গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হতো। বুদ্ধিজীবীরাও হাসিনার একটু সমালোচনা করতেন। কিন্তু সময়মতো তাদের দ্বারা খেলাতেন।

আনিসুজ্জামান, সৈয়দ হক, জাফর ইকবাল লীগের কোনো পদ নেননি। কিন্তু ওবায়দুল কাদেরসহ আওয়ামী মহল জানত, তাদের চেয়ে হাসিনার কাছে আনিসুজ্জামান, সৈয়দ হকের গুরুত্ব বেশি। হাসিনা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে চেয়ার এগিয়ে দিয়ে, আদব দেখিয়ে বাকিদের সেই ইশারাটা দিতেন। ফলে বুদ্ধিজীবীরা কোনো অনুষ্ঠানে গেলে প্রোটোকল পেতে অসুবিধা হতো না। সৈয়দ হকরা তাই লেখালেখিতে মনোযোগ দিতে পারেন, অন্য কিছু করতে হয় না। অবশ্য হাসিনার শেষ আমলে সবই শেষ হয়ে গিয়েছিল। হাসিনা বুদ্ধিজীবীদের ইমেজ শেষ করে দিয়েছেন। ফলে যে কিশোররা জাফর ইকবালের সায়েন্স ফিকশন বলতে অজ্ঞান ছিল, তারাও আর জাফর ইকবালের কথা শোনেনি।

বিএনপিতে সেটা নেই। এখানে বুদ্ধিজীবী মানেই দলীয় নেতা। খারাপভাবে বললে, দলীয় ক্যানভাসার। আব্দুল হাই শিকদারকে জাসাসের নেতা হতে হয়। বিএনপির জাসাস আছে, কিন্তু সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট নেই। লীগের বুদ্ধিজীবীদের লীগার বলে চেনা যায় না, কিন্তু বিএনপির বুদ্ধিজীবীদের চেনা যায়। এই আড়ালটাই ঘটনা। এই আড়ালটাই জনগণের ওপর প্রভাব বিস্তারে ভূমিকা রাখে।

বিএনপির বুদ্ধিজীবীদের দলীয় খেদমতগার হতে হয় বলে সাহিত্যে মন লাগাতে পারেন না। তাদের তাই তেমন কাজ নেই। সৈয়দ হকের সঙ্গে আব্দুল হাই শিকদারের সাহিত্যের তফাৎটাই বাকি পার্থক্য বোঝার জন্য যথেষ্ট। সৈয়দ হক সাহিত্যিক হিসেবে যত বড় হতেন, লীগও তত বড় হতো।

বিএনপির নিজ স্বার্থেই তাই বুদ্ধিজীবীদের নিরপেক্ষ রাখতে হবে। সেটা সম্ভব না হলেও অভিনয়টুকু করতে হবে। তারেক রহমানের সঙ্গে ড. ইউনূসের সাক্ষাতের সময় গুরুত্বপূর্ণ দুটি বই উপহার দেওয়া সেই নতুন দিনের ইশারা সম্ভবত।

নাহিদ হাসান : কবি, লেখক ও সংগঠক

মতামত লেখকের নিজস্ব