এইচএসসির ফল বিপর্যয়ে খাতা চ্যালেঞ্জের হিড়িক

এম এইচ রবিন
২৬ অক্টোবর ২০২৫, ০৯:১৪
শেয়ার :
এইচএসসির ফল বিপর্যয়ে খাতা চ্যালেঞ্জের হিড়িক

চলতি বছর এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফলে যে বিপর্যয় ঘটেছে তা গত ২০ বছরের মধ্যে সর্বাধিক। পাসের হার মাত্র ৫৮ দশমিক ৮৩ শতাংশ। ৪১ দশমিক ১৭ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় ৫ লাখ ৮ হাজার শিক্ষার্থীই অনুত্তীর্ণ হয়েছেন। অপ্রত্যাশিত এ ফল প্রকাশের পর থেকেই শিক্ষার্থীদের মধ্যে এক ধরনের অসন্তোষ দেখা যাচ্ছে। সঙ্গত কারণেই এবার শিক্ষা বোর্ডগুলোতে খাতা চ্যালেঞ্জের হিড়িক পড়েছে।

ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের সূত্রে জানা গেছে, ১১টি শিক্ষা বোর্ড মিলে ১ লাখ ৯৩ হাজার ২৫৮ জন শিক্ষার্থী খাতা পুনর্মূল্যায়নের আবেদন করেছেন। এই শিক্ষার্থীরা মোট ৪ লাখ ২৮ হাজার ৪৫৮টি খাতা পুনর্নিরীক্ষণের দাবি তুলেছেন।

বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক এসএম কামাল উদ্দিন হায়দার জানিয়েছেন, পুনর্মূল্যায়নের ফল আগামী ১৬ নভেম্বর প্রকাশ হবে। এবারের আবেদন প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ অনলাইনভিত্তিক হওয়ায় স্বচ্ছতা ও ন্যায্যতা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে।

তিনি জানান, এবার কোনো বোর্ডেই এসএমএসের মাধ্যমে আবেদন গ্রহণ করা হয়নি, সব আবেদন হয়েছে ডিজিটাল পদ্ধতিতে। এবার খাতা পুনর্মূল্যায়নে সর্বাধিক আবেদন পড়েছে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে। এখানে ৬৬ হাজার ১৫০ শিক্ষার্থী ১ লাখ ৩৬ হাজার ৫০৬টি খাতা পুনর্মূল্যায়নের জন্য আবেদন করেছেন। আর সবচেয়ে কম আবেদন বরিশাল বোর্ডে, মাত্র ৮ হাজার ১১১ জন শিক্ষার্থী মোট ১৭ হাজার ৪৮৯টি খাতা পুনর্নিরীক্ষণের আবেদন করেছেন।

বোর্ডভিত্তিক পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা গেছে, খাতা পুনর্মূল্যায়নের আবেদনে ঢাকার পরেই রয়েছে চট্টগ্রাম বোর্ড। এ বোর্ডে ২২ হাজার ৫৯৫ শিক্ষার্থী মোট ৪৬ হাজার ১৪৮টি খাতা পুনর্নিরীক্ষণের আবেদন করেছেন। এরপর কুমিল্লা বোর্ড। এখানে ২২ হাজার ১৫০ শিক্ষার্থী ৪২ হাজার ৪৪টি খাতা চ্যালেঞ্জ করেছেন। রাজশাহী ও যশোর বোর্ডে আবেদনকারীর সংখ্যা যথাক্রমে ২০ হাজার ৯২৪ এবং ২০ হাজার ৩৯৫। এ দুই বোর্ডে ৩৬ হাজার ২০৫টি খাতা পুনর্মূল্যায়নের দাবি তোলা হয়েছে। দিনাজপুর বোর্ডে ১৭ হাজার ৩১৮ শিক্ষার্থী ২৯ হাজার ২৯৭টি খাতা আর ময়মনসিংহে ১৫ হাজার ৫৯৮ শিক্ষার্থী ৩০ হাজার ৭৩৬টি খাতা পুনর্নিরীক্ষণের আবেদন করেছেন। সিলেট বোর্ডে ১৩ হাজার ৪৪ শিক্ষার্থী ২৩ হাজার ৮২০টি খাতা পুনর্মূল্যায়নের জন্য আবেদন জমা দিয়েছেন। এ ছাড়া কারিগরি বোর্ডে ১২ হাজার ৭ জন শিক্ষার্থী ১৫ হাজার ৩৭৮টি খাতা এবং মাদ্রাসা (আলিম) বোর্ডে ৭ হাজার ৯১৬ শিক্ষার্থী ১৪ হাজার ৭৩৩টি খাতা পুনর্মূল্যায়নের আবেদন করেছেন।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, প্রতিবারই ফল প্রকাশের পর খাতা চ্যালেঞ্জের ঢল দেখা যায়। এটা মূল্যায়ন ব্যবস্থার অসংগতি নির্দেশ করে। দীর্ঘমেয়াদে পরীক্ষার কাঠামো ও মূল্যায়ন মানোন্নয়ন ছাড়া এ প্রবণতা থামবে না। তিনি বলেন, খাতা চ্যালেঞ্জ একদিকে যেমন শিক্ষার্থীদের আস্থার শেষ আশ্রয়, অন্যদিকে এটি শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি এক গভীর প্রশ্নও তোলে যে, আমরা কি সত্যিই সঠিকভাবে শেখাচ্ছি ও মূল্যায়ন করছি?

কেন এমন ফল বিপর্যয়? এমন প্রশ্নে এ শিক্ষাবিদ বলেন, এর পেছনে তিনটি বড় কারণ রয়েছে। এক. শিক্ষার্থীদের শেখার ঘাটতি (বিশেষ করে মহামারীর সময়কাল থেকে); দুই. প্রশ্নের মান ও কাঠামোতে বৈষম্য এবং তিন. মূল্যায়নের একক মানদণ্ডের অভাব।

এ থেকে উত্তরণ প্রসঙ্গে এই অধ্যাপক বলেন, এইচএসসির ফল বিপর্যয় শুধু শিক্ষার্থীদের নয়, পুরো শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য এক সতর্কবার্তা। পুনর্মূল্যায়নে কিছু শিক্ষার্থীর ভাগ্য হয়তো বদলাতে পারে। কিন্তু শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতি আস্থা ফেরাতে আরও গভীর সংস্কার প্রয়োজন।

শিক্ষার্থীদের আশা-হতাশা, অভিভাবক-শিক্ষকের মত

ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী তাহমিদা ইসলাম বলেন, ইংরেজিতে ‘এ’ পাওয়ার আশা ছিল আমার। কিন্তু পেয়েছি ‘সি’। তাই আবেদন করেছি। অন্তত জানব, ভুলটা কোথায় হয়েছে।

চট্টগ্রাম কলেজের শিক্ষার্থী সুব্রত দাশ বলেন, আমাদের অনেকের ফল প্রত্যাশার চেয়ে অনেক খারাপ হয়েছে। বোর্ড যদি সঠিকভাবে খাতা দেখে, অনেকের ভবিষ্যৎ বদলে যেতে পারে।

মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক শাহনাজ পারভীন বলেন, শিক্ষার্থীরা এত পরিশ্রম করেও এমন ফল পাওয়ায় মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে। খাতা চ্যালেঞ্জের সুযোগটা অন্তত তাদের একটুখানি ভরসা দিচ্ছে।

সরকারি একটি কলেজের শিক্ষক মো. রুবেল আহমেদ। তিনি বলেন, শিক্ষার্থীরা খাতা পুনর্মূল্যায়নে চ্যালেঞ্জের মাধ্যমে বোর্ডের প্রতি আস্থা পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করছে। তবে মূল সমস্যা মূল্যায়ন প্রক্রিয়ার মানে বলেই মনে করেন তিনি।