প্রয়োজন ছাত্রীদের নিজস্ব যানবাহন
বিশ্বের শীর্ষ যানজটের শহরগুলোর একটি রাজধানী ঢাকা। প্রতিদিনই যানজটের কবলে পড়ে কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে নগরের কর্মজীবী মানুষের। এই যানজটের অন্যতম কারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগামী শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত যানবাহন। তবে সবার পক্ষে এটা সম্ভব হয় না। বিশেষ করে ঢাকার বাইরে থেকে আসা কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া ছাত্রছাত্রীদের ব্যবহার করতে হয় গণপরিবহন। তাতে হয় নানা অসুবিধা। এই অসুবিধা একজন ছাত্রীকে ট্রমা পর্যন্ত নিয়ে শিক্ষাজীবনের ইতিটানার মতোও ঘটনা ঘটেছে। গণপরিবহনে চালক, সহকারী ও অন্য পুরুষ সহযাত্রীদের দ্বারা অসদাচরণ, কটূক্তি ও যৌন হয়রানির বিষয়ে নারীরা প্রায়ই অভিযোগ করেন। কখনও উঠে আসে ভয়ানক পাশবিক নির্যাতনের খবরও। অনাকাক্সিক্ষত স্পর্শ আর বাজে ভাষায় নারীদের আক্রমণ তো নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা! নারীদের সংরক্ষিত সিটসংখ্যা ২৫ শতাংশের কম। ফলে গণপরিবহনে নারীদের সঙ্গে চরম বৈষম্য প্রতীয়মান হচ্ছে। গণপরিবহনে নিয়মিত চলাচল করেন রাজধানীর সিটি কলেজের এমন কয়েকজন নারী শিক্ষার্থীর হয়রানি ও ভোগান্তির কথা তুলে ধরা হলো। অনার্স ২য় বর্ষে পড়া শিপরা বলেন, ক্লাস শেষ করে বাস পেতে খুব ঝামেলা হয়, বাস তো পাওয়াই যায় না সময়মতো। কারণ যে হারে জনসংখ্যা বাড়ছে, সে হারে বাড়ছে না গণপরিবহন। নিয়মিত কলেজে যাতায়াতের মাধ্যম হিসেবে গণপরিবহন ব্যবহার করতে হয়। ফলে অব্যাহত রয়েছে ভোগান্তিও। যত দিন যাচ্ছে, পরিবহনে চলাচল নারীদের জন্য অস্বস্তি বেড়ে যাচ্ছে। সহযাত্রীদের সঙ্গে ঠেলাঠেলি করে বাসে ওঠা, গায়ের সঙ্গে ধাক্কা লাগা, ওঠার সময় হেলপারদের পিঠে হাত দেওয়ার চেষ্টা করা, বাসভর্তি মানুষ থাকলেও দাঁড়িয়ে যাওয়া। ক্লাস শেষ করে বাস পাওয়া খুব ঝামেলা। বাসে যাওয়ার সময় কোনো নারীর সঙ্গে বাজে কিছু হলে আশপাশের যাত্রীরা হাঁ করে তাকিয়ে থাকেন। সেভাবে কেউ এগিয়ে আসেন না তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ করার জন্য। আরেক শিক্ষার্থী আরিফা বলেন, দৈনন্দিন যাতায়াতের জন্য গণপরিবহন ব্যবহার করতে হয়। গণপরিবহনে নারীদের আসন সংখ্যা পুরুষদের তুলনায় কম। তারপরও নারীদের জন্য নির্ধারিত আসনে বসে অনেক সময় পুরুষরা যাতায়াত করে এবং প্রতিবাদ করলে বিভিন্ন কটুকথা শুনতে হয়। আর এসব অপ্রীতিকর পরিস্থিতিতে কোনো বাসযাত্রী নারীর পক্ষে কখনও কথা বলে না। দেশের বিভিন্ন কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব পরিবহন ব্যবস্থা থাকলেও সেসব প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা অনেক কম। আবার যেসব কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব পরিবহন ব্যবস্থা আছে তাও প্রয়োজনের তুলনায় সামান্য। যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে সপ্তাহের বেশির ভাগ সময় সে যানবাহনগুলো বিকল থাকে। তাই যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিবহন ব্যবস্থা থাকার পরও শিক্ষার্থীরা তা দ্বারা উপকৃত হয় না কিংবা সব শিক্ষার্থী যাতায়াত করার মতো আসনও নেই, সেসব যানবাহনকে যাতে বিশেষ করে নারী শিক্ষার্থীদের চাহিদানুযায়ী তৈরি করা হয় কিংবা প্রতি রুটে একাধিক যানবাহনের ব্যবস্থা করা হয় সে ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি কামনা করতে হবে। বিভিন্ন সময়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে সমস্যার সমাধান করার আশ্বাস দিলেও তা বাস্তবায়ন হয় না। কাজেই নারী শিক্ষার্থীদেরও বিভিন্ন পরিবহনে হাফ ভাড়া দিয়ে ঝুলতে ঝুলতে কয়েক কিলোমিটার রাস্তা পাড়ি দিয়ে ক্লান্ত শরীরে ক্লাস করতে আসতে হয় কিংবা ক্লাস শেষে প্রচণ্ড ভিড়ের মধ্যে ক্লান্ত শরীরে বাসায় ফিরতে হয়। যে কারণে আসা-যাওয়ার মধ্যেই শিক্ষাব্যবস্থা সংক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে। কেননা শিক্ষার্থী যখন পড়াশোনা করবে তখন সে যাত্রাপথের ধকলের কারণে ঘুমিয়ে পড়ে কিংবা অসুস্থ থাকে। এ ছাড়া উপরোক্ত মানসিক যন্ত্রণা তো আছেই। ব্যক্তিগত গাড়ি কিংবা রিকশাসহ অন্য যে কোনো পরিবহনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অনেকে যায়। এতে একদিকে যেমন জ্বালানির অপচয় হচ্ছে অন্যদিকে রাজধানীতে যানজট তৈরি হচ্ছে। ঢাকার এই যানজট সমস্যা নিরসনে ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাতায়াত বন্ধের উদ্যোগ নিয়েছিল একবার তৎকালীন শিক্ষা মন্ত্রণালয়। শুধু নারী শিক্ষার্থীদের জন্য আলাদা বাস সার্ভিস করাটা, বেশ জরুরি হয়ে উঠেছে। ঢাকা শহরের যেসব রুটে গণপরিবহন চলাচল করে, সেই একই রুটে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ছাত্রীর সংখ্যার অনুপাতে আলাদা বাস সেবা চালু করা যেতে পারে, যে বাসে ছাত্রী ছাড়া আর কেউ উঠতে পারবেন না। বাস ভাড়া নির্ধারিত থাকবে, যা অন্যান্য বাসের ভাড়ার অর্ধেক। এতে পরিবহন মালিকদের যে ঘাটতি থাকবে, তা পূরণে ভর্তুকি দেবে সরকার। যেভাবে গেটলক সার্ভিস চলে, সেই মডেলে নারী শিক্ষার্থীদের বাসের ডিউটি রোস্টার ও রাউটিং নির্ধারণ করা যেতে পারে। এতে করে ছাত্রীদের অন্য যাত্রীদের সঙ্গে গাদাগাদি করে চলাচল করতে হবে না। অতিরিক্ত ভিড়ের চাপে পিষ্ট হতে হবে না। তাদের স্টপেজ বা কাউন্টার আলাদা হওয়ায় সাধারণ যাত্রীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে বাসে ওঠার জন্য ধাক্কাধাক্কি করতে হবে না। আরেকটি সুবিধা হচ্ছে, যেহেতু এই বিশেষ সেবা শুধুই ছাত্রীদের জন্য নির্ধারিত, তাই এই বাসগুলো চলাচল করবে অপেক্ষাকৃত কম সময়ে, কেননা সাধারণ যাত্রী ওঠানামার জন্য তাদের যত্রতত্র থেমে থাকতে হবে না।