নীরবতা ভাঙার সময় এখনই
কর্মক্ষেত্রে যৌন নিপীড়ন
ঢাকার এক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন নীলা রহমান (ছদ্মনাম)। অফিসে সহকর্মী ও এক সিনিয়র কর্মকর্তার অশালীন মন্তব্য, অযাচিত আচরণ- সবকিছু সহ্য করেও চাকরি হারানোর ভয়ে চুপ ছিলেন তিনি। একদিন সাহস করে অভিযোগ জানালে উল্টো তাকেই ‘অতিরিক্ত সংবেদনশীল’ বলে অপমান করা হয়। শেষে মানসিক চাপ সহ্য করতে না পেরে নীলা চাকরি ছেড়ে দেন।
নীলার গল্পটি ব্যতিক্রম নয়- বাংলাদেশে হাজারো নারী প্রতিদিন এমন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন।
সম্প্রতি দেশে কর্মক্ষেত্রে যৌন নিপীড়নের কয়েকটি ঘটনা আলোচনায় এসেছে। অফিস, গার্মেন্ট, ব্যাংক, মিডিয়া- সব ক্ষেত্রেই নারীদের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) জানায়, গত কয়েক বছরে যৌন হয়রানির অভিযোগের সংখ্যা উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে। তবে প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি, কারণ অধিকাংশ নারী ভয় বা সামাজিক লজ্জার কারণে মুখ খুলতে পারেন না।
আরও পড়ুন:
বিশেষজ্ঞ যা বলেন
এ প্রসঙ্গে আইন কী বলে জানতে চাইলে সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী মিতি সানজানা বলেন,‘যৌন নিপীড়ন শুধু একজন নারীর প্রতি অন্যায় নয়, এটি পুরো কর্মপরিবেশকে বিষাক্ত করে তোলে। কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা না থাকলে নারী তার মেধা ও দক্ষতা পুরোপুরি প্রকাশ করতে পারে না।’ ব্যারিস্টার মিতি সানজানা জানান, ‘দেশে নারী কর্মীর সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ৮০ লাখ’, ‘কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির অভিযোগ (গত ৫ বছর) : ৩,২০০+’, প্রতিরোধ কমিটি থাকা প্রতিষ্ঠান : মাত্র ৩০%, ২০০৯ সালে বাংলাদেশ হাইকোর্ট একটি ঐতিহাসিক রায় দেন’ ‘আইন আছে ঠিকই কিন্তু প্রয়োগ কোথায়?’ কোর্টে প্রতিটি সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে কমিটি গঠনের নির্দেশ দেওয়া হয়। ‘যৌন হয়রানি প্রতিরোধ নীতিমালা’ও তৈরি হয়। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, অনেক প্রতিষ্ঠানে এই কমিটি নেই, আর থাকলেও তা কার্যকর নয়। অভিযোগ করলে অনেক নারী উল্টো চাকরিচ্যুত হন বা মানসিক চাপে পড়েন। অনেকে বেছে নেন আত্মহত্যার পথও।’ অনেক প্রতিষ্ঠান এখনও যৌন হয়রানিকে ‘ব্যক্তিগত বিষয়’ মনে করে। অথচ এটি একটি অপরাধ- যার জন্য শাস্তির বিধান রয়েছে। ভিকটিমের করণীয় প্রসঙ্গে মিতি সানজানা বলেন, যদি কেউ কর্মক্ষেত্রে যৌন নিপীড়নের শিকার হন, তাহলে প্রথমে ঘটনাটি লিখিতভাবে নথিভুক্ত করা জরুরি- সময়, স্থান, ঘটনার বিবরণ ও সম্ভাব্য সাক্ষীর নামসহ। এরপর প্রতিষ্ঠানের প্রতিরোধ কমিটিতে অভিযোগ জানাতে হবে। যদি তাতে ফল না মেলে, তবে ভুক্তভোগী স্থানীয় থানায় জিডি (সাধারণ ডায়েরি) করতে পারেন অথবা মানবাধিকার সংস্থা, মহিলা পরিষদ বা লিগ্যাল এইড সেন্টারের সহায়তা নিতে পারেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- নিজেকে দোষী ভাবা নয়। ভুক্তভোগী কোনো অপরাধ করেননি; অপরাধী তিনি, যিনি হয়রানি করেছেন। যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধের জন্য শুধু আইন নয়, প্রয়োজন সচেতনতা। প্রতিটি অফিসে নিয়মিত প্রশিক্ষণ, আচরণবিধি এবং গোপন অভিযোগ ব্যবস্থা থাকা উচিত। পুরুষ সহকর্মীদের মধ্যেও সম্মানবোধ ও সহানুভূতির সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। এ বিষয় নতুন করে সুরক্ষা আইন, ২০২৫’ নামে মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে খসড়া প্রকাশিত হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, বিভিন্নজনের মতামত নিয়ে আবারও খসড়াটি পর্যালোচনা ও পূর্ণাঙ্গ আইন আকারে পাস হবে। যৌন হয়রানির সংজ্ঞাটি নির্দিষ্ট নয়। ফলে শাস্তি কেমন হবে সে বিষয়টিও পরিষ্কার নয়। তাই নির্দিষ্ট কারণ উল্লেখ করে আইনটি দ্রুতই পাস ও বাস্তবায়ন দরকার। খসড়ায় আগের নির্দেশনা বহাল রেখে অভিযোগ তদন্ত প্রক্রিয়া, শাস্তিমূলক ব্যবস্থা, কোন কোন কাজ যৌন হয়রানি হিসেবে গণ্য হবে এবং মিথ্যা অভিযোগ ও সাক্ষ্য দেওয়ার শাস্তিসহ বিভিন্ন বিষয় বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়। যেসব কাজ যৌন হয়রানি হিসেবে গণ্য হবে, শারীরিক সংস্পর্শ এবং যৌনতার জন্য অগ্রসর হওয়া বা এ ধরনের প্রচেষ্টা, যৌন আকাক্সক্ষা পূরণের জন্য প্রশাসনিক, কর্তৃত্বমূলক বা পেশাদারি ক্ষমতার অপব্যবহার, যৌন অনুগ্রহের অনুরোধ জানানো; ভয়, প্রতারণা বা মিথ্যা আশ্বাসের মাধ্যমে যৌন সম্পর্ক স্থাপন বা চেষ্টা। যৌনতাবিষয়ক মন্তব্য, বক্তব্য, তামাশা বা অন্যান্য মৌখিক ক্রিয়াকলাপ, যাতে যৌনতার প্রভাব বিদ্যমান; পর্নোগ্রাফি বা যৌনতাপূর্ণ ইঙ্গিত, কামুক দৃষ্টি, শিস বা যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ কোনো অঙ্গভঙ্গি, ব্ল্যাকমেইলিং বা মর্যাদাহানির উদ্দেশ্যে কারও স্থির বা ভিডিওচিত্র ধারণ ও সংরক্ষণ, প্রদর্শন, বিতরণ, বিপণন ও প্রচার বা প্রকাশ করা, যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ কোনো বস্তু, ছবি, শব্দ, ইমেইল, টেক্সট বার্তা বা খুদে বার্তা বা লিখিত নোট ব্যবহার; সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা অন্য অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলোতে যৌন সম্পর্কযুক্ত আপত্তিকর কোনো তথ্য বা বিষয় প্রকাশ করা বা যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ আপত্তিকর বার্তা প্রেরণ করা বা কোনো অশালীন মন্তব্য করা; কারও জেন্ডার পরিচয়ের ওপর ভিত্তি করে কটূক্তি করা বা অপমানজনক মন্তব্য করা; একজন ব্যক্তির জেন্ডার পরিচয়ের ওপর ভিত্তি করে পিতৃতান্ত্রিক ধারণাপ্রসূত অবমাননাকর মন্তব্য করা এবং অন্য যে কোনো আচরণ, যা যৌন হয়রানির সংজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বাংলাদেশে নারীর অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা এখন বাস্তবতা। কিন্তু এই যাত্রাকে টেকসই করতে হলে প্রতিটি কর্মক্ষেত্রকে হতে হবে নিরাপদ, সম্মানজনক এবং বৈষম্যমুক্ত। নীরবতা নয়- সময় এসেছে প্রতিবাদের।
আরও পড়ুন:
কোনো বাধাই দমাতে পারেনি জান্নাতুলকে
আরও পড়ুন:
কন্যাসন্তানের প্রতি বৈষম্য নয়