জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে

সরকারি দপ্তরের বিদ্যুৎ বিল বকেয়া

সম্পাদকীয়
২৬ অক্টোবর ২০২৫, ০৪:৪০
শেয়ার :
জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে

বিদ্যুৎ বিল বকেয়া থাকলেই ব্যক্তিমালিকানাধীন বা বেসরকারি পর্যায়ের গ্রাহকদের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। কিন্তু একই নিয়ম যখন সরকারি প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয় না, তখন তা শুধু বৈষম্যই নয়- রাষ্ট্রীয় জবাবদিহির চরম অভাবের প্রতিফলনও বটে। বর্তমানে সরকারি দপ্তর ও মন্ত্রণালয়গুলোর কাছে বিদ্যুৎ বিল বকেয়া আড়াই হাজার কোটি টাকারও বেশি। এক যুগের প্রচেষ্টা, অসংখ্য চিঠি, বৈঠক, নির্দেশনা- সবই যেন অর্থহীন হয়ে পড়েছে সরকারের নিজস্ব প্রতিষ্ঠানের কাছে। এমন পরিস্থিতি রাষ্ট্রের প্রশাসনিক কাঠামোর অদক্ষতা, অব্যবস্থাপনা ও জবাবদিহিহীনতারই বড় উদাহরণ।

বিদ্যুৎ বিভাগের সর্বশেষ হিসাবে দেখা যায়, সরকারের ৫৬টি মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও দপ্তরের কাছে বিদ্যুৎ বিল বকেয়া পড়েছে প্রায় ২,৫০০ কোটি টাকারও বেশি। এর মধ্যে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে এক হাজার কোটি টাকা, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের ৬১৫ কোটি, আর গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের ১৫৭ কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে।

বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলো- যেমন ডিপিডিসি, ডেসকো, নেসকো, পিডিবি, বাপবিবো ও ওজোপাডিকো- সরকারি প্রতিষ্ঠানের এই বিল বকেয়া নিয়ে কার্যত অসহায়। কেননা সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার ক্ষমতা থাকলেও সেটি কার্যত প্রয়োগ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে নীতিগত কারণে। ফলে বছরের পর বছর ধরে বিল জমে যাচ্ছে, আর বিদ্যুৎ বিভাগ আর্থিক সংকটে পড়ছে।

এই আর্থিক সংকটের প্রতিক্রিয়া পড়ছে গোটা বিদ্যুৎ খাতের ওপর। বিতরণ কোম্পানিগুলো পিডিবি থেকে বিদ্যুৎ ক্রয় করে বিক্রি করে থাকে, কিন্তু তারা যখন বকেয়া আদায় করতে পারে না, তখন নিজেরাই সময়মতো পিডিবিকে পরিশোধ করতে পারে না। এতে তৈরি হয় আর্থিক জট, যা শেষ পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন, সরবরাহ ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যবস্থাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এর প্রভাব পড়ে সাধারণ মানুষের ঘাড়ে- লোডশেডিং, বিল বাড়ানোর মতো নীতিগত পদক্ষেপে।

সবচেয়ে উদ্বেগজনক দিক হলো, গত এক দশকে বিভিন্ন সরকার একই সমস্যার সমাধানে বারবার একই ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে- চিঠি দেওয়া, বৈঠক করা, সতর্কতা জারি করা- কিন্তু ফল শূন্য। এর কারণ একটাই- কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেই। সরকারি দপ্তরের কর্মকর্তারা জানেন, বিল না দিলেও কিছু হবে না। এই মানসিকতা পরিবর্তন না হলে বিদ্যুৎ বিভাগ যতই চেষ্টা করুক, বকেয়া আদায়ের চক্র থেকে মুক্তি মিলবে না।

এই অবস্থায় প্রয়োজন নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে কঠোর সিদ্ধান্ত। সরকারি দপ্তরের বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ বাধ্যতামূলক করতে হবে এবং বেসরকারি গ্রাহকদের মতো তাদেরও একই নিয়মে আনতে হবে। কোনো দপ্তর বকেয়া রাখলে নির্দিষ্ট সময় পর তাদের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার বিধান কার্যকর করতে হবে- তা যত উচ্চপর্যায়েরই হোক না কেন। বাজেটের দোহাই দিয়ে বছরের পর বছর বিল আটকে রাখা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ সরকারি দায়িত্বের অংশ, সদিচ্ছার বিষয় নয়।

একই সঙ্গে বিদ্যুৎ বিভাগকে তার প্রশাসনিক সক্ষমতা বাড়াতে হবে। প্রিপেইড মিটার বা অগ্রিম বিল নেওয়ার মতো পদক্ষেপ কেবল সাধারণ গ্রাহকের ওপরই নয়, সরকারি দপ্তরের ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করা যেতে পারে। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর বাজেটের মধ্যেই বিদ্যুৎ বিলের একটি নির্দিষ্ট খাত বরাদ্দ রাখা এবং তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরিশোধের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। প্রয়োজনে অর্থ মন্ত্রণালয় ও বিদ্যুৎ বিভাগের মধ্যে সমন্বয় করে মাসিক বিল পরিশোধের জন্য কেন্দ্রীয় ক্লিয়ারিং ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে।

সবশেষে বলা যায়, সরকারি দপ্তরের বিদ্যুৎ বিল বকেয়া শুধু আর্থিক নয়- এটি প্রশাসনিক ও নৈতিক অবক্ষয়ের প্রতিচ্ছবি। যখন রাষ্ট্র নিজেই নিজের বিল পরিশোধে ব্যর্থ হয়, তখন নাগরিকদের কাছ থেকে শৃঙ্খলা, দায়িত্ববোধ বা কর পরিশোধের প্রত্যাশা করা বাস্তবসম্মত নয়। তাই এখনই প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও প্রশাসনিক সাহসের, যেন সরকারি দপ্তরগুলোও সেই আইন মেনে চলে, যে আইন মেনে চলে দেশের মানুষ।