ক্লাসের বাইরে ক্লাস সহশিক্ষা
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে অনেকেই ভাবে এবার শুধু লেকচার শুনব, পরীক্ষায় ভালো করব, আর একদিন গাউন পরে ছবি তুলে ডিগ্রি হাতে ফিরব। কিন্তু যদি পুরো চার বছর শুধু এই রুটিনেই কাটে, তাহলে সেটা অনেকটা নদীর ধারে বসে মাছের গল্প শোনার মতো জলের ছোঁয়া না পেয়েই ফেরত আসা। বিশ্ববিদ্যালয়জীবন শুধু বইয়ের পাতায় সীমাবদ্ধ নয়, এর বাইরেও এক বিশাল শেখার মাঠ আছে- যাকে আমরা বলি সহশিক্ষা কার্যক্রম বা সংগঠনে যুক্ত হওয়া। বিস্তারিত লিখেছেন মাহাদী হাসান-
সহশিক্ষা কার্যক্রম হলো পাঠ্যবইয়ের বাইরে নিজের পছন্দের অন্য কোনো বিষয় চর্চা করা। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরে বা বাইরে ব্যক্তিগত উদ্যোগে একজন শিক্ষার্থী যেসব শিক্ষামূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকে।
সহশিক্ষা কার্যক্রমগুলোও একেকটি গুরুত্বপূর্ণ দক্ষতা। একজন শিক্ষার্থী এসব কর্মকাণ্ডগুলোর মধ্য দিয়ে নিজেকে পড়ালেখার পাশাপাশি বিশেষ কিছু বিষয়ে দক্ষ করে তোলে।
UNESCO-i সংজ্ঞা অনুযায়ী, সহশিক্ষা কার্যক্রম হলো এমন সব আয়োজন যা পাঠ্যসূচির বাইরে থেকেও শিক্ষার্থীর পূর্ণাঙ্গ বিকাশে অবদান রাখে। বিতর্ক, নাটক, ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, রোবোটিকস, স্বেচ্ছাসেবা, গবেষণা গোষ্ঠী; সবই এর অন্তর্ভুক্ত। এগুলো কেবল বিনোদন নয়, বরং বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের ‘প্রায়োগিক ল্যাবরেটরি’, যেখানে তত্ত্ব বাস্তবে রূপ নেয়।
কেন এই অংশগ্রহণ এত জরুরি- এ নিয়ে সাম্প্রতিক গবেষণাগুলো বেশ স্পষ্ট ছবি দেয়। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব কলেজ অ্যান্ড এমপ্লয়ার্স (National Association of Colleges and Employers)-এর ২০২৩ সালের জরিপে দেখা গেছে, নিয়োগদাতাদের প্রায় ৮০ শতাংশ প্রার্থীর নেতৃত্বের অভিজ্ঞতা ও দলগত কাজের অভিজ্ঞতাকে বাড়তি যোগ্যতা হিসেবে ধরে। জার্নাল অব এডুকেশন অ্যান্ড ওয়ার্ক (Journal of Education & Work)-এ প্রকাশিত ২০২২ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, যারা অন্তত একটি সংগঠনের নেতৃত্ব দিয়েছে, তাদের কর্মজীবনে নেতৃত্বের ভূমিকায় পৌঁছানোর সম্ভাবনা ৬০ শতাংশ বেশি। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও একই ধারা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যারিয়ার ক্লাবের এক সমীক্ষা (২০২৪) বলছে, সহশিক্ষা কার্যক্রমে যুক্ত শিক্ষার্থীরা গড়ে অন্যদের চেয়ে পাঁচ মাস আগে চাকরি পেয়ে যান।
আরও পড়ুন:
পাঠাগার গড়া যাদের স্বপ্ন ছিল
এমন সাফল্যের বাস্তব উদাহরণও আছে প্রচুর। বুয়েট রোবোটিকস ক্লাব জাপানে অনুষ্ঠিত একটি রবোকাপ (RoboCup)-এ রানারআপ হয়েছিল। সেই দলের তিনজন এখন নিজস্ব এআই স্টার্টআপ চালাচ্ছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিতর্ক সংগঠন (DUDS)-এর প্রাক্তন সদস্যদের মধ্যে অনেকেই এখন শীর্ষ সংবাদমাধ্যম, করপোরেট এবং নীতিনির্ধারণী প্রতিষ্ঠানে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার ক্লাব করোনাকালে অনলাইন নাট্যচর্চা শুরু করে দেশের নানা প্রান্তের শিক্ষার্থীদের এক প্ল্যাটফর্মে এনেছিলÑ যা পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক উৎসবেও জায়গা করে নেয়।
তবে সহশিক্ষা কার্যক্রমের প্রভাব শুধু সিভি বা চাকরির সুযোগে সীমাবদ্ধ নয়। এগুলো গড়ে তোলে এক ধরনের আত্মবিশ্বাস, যা বইয়ের পাতায় পাওয়া যায় না। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক প্রাক্তন ছাত্রের গল্প আমার মনে পড়ে। তিনি ফটোগ্রাফি ক্লাবের সদস্য ছিলেন। একদিন পরীক্ষা শুরু হওয়ার ঠিক আগে ক্যামেরা হাতে হলে ঢুকে পড়লেন। পরীক্ষক অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘ক্যামেরা নিয়ে হলে কেন?’ তিনি হেসে বললেন, ‘স্যার, শুধু খাতার উত্তর নয়, মুখের ভাঁজও তো ইতিহাসের অংশÑ আজকের এই ভাঁজগুলোও সংরক্ষণ করা দরকার।’ শিক্ষক মুচকি হেসেছিলেন, আর সেই পরীক্ষার পর ছবিগুলো বিভাগীয় ম্যাগাজিনে ছাপা হয়। আজ সেই শিক্ষার্থী দেশের একজন নামকরা ফটো জার্নালিস্ট। হয়তো ক্যামেরা নিয়ে হলে ঢোকার সেই ‘অবাধ্যতা’ই তার ক্যারিয়ারের প্রথম ধাপ ছিল।
দেখুন, এভাবেই ক্লাব-সংগঠনের অভিজ্ঞতা অনেক সময় জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। সহশিক্ষা কার্যক্রম শেখায়, কীভাবে ভিন্নমতের মানুষকে এক লক্ষ্যে এনে একসঙ্গে কাজ করানো যায়। শেখায় সময় ব্যবস্থাপনা, নেতৃত্ব, যোগাযোগÑ এই তিনটিই জীবনের সবচেয়ে বড় সফট স্কিল। শেখায় কীভাবে ব্যর্থতা মেনে নিতে হয়, কীভাবে আবার উঠে দাঁড়াতে হয়।
আর হ্যাঁ, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণÑ এগুলো আত্মবিশ্বাস তৈরি করে, যে আত্মবিশ্বাস কোনো বইয়ের পাতায় পাওয়া যায় না।
আরও পড়ুন:
বৈষম্য ঘোচানোই সত্যিকার মানবিক অর্জন
আমি প্রায়ই নতুন শিক্ষার্থীদের বলিÑ শুধু বই পড়লে আপনি হয়তো তত্ত্বে শক্ত হবেন, কিন্তু বাস্তব জীবনের খেলার মাঠে নামতে গেলে সেই জ্ঞানটাকে কাজে লাগানোর জায়গা খুঁজে পাবেন না। ক্লাসে শেখা জ্ঞান আপনাকে ডিগ্রি দেবে, কিন্তু ক্লাবের মাঠে শেখা অভিজ্ঞতা দেবে আত্মপরিচয়।
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হওয়ার সময় হাতে শুধু ডিগ্রি থাকলে সেটা অসম্পূর্ণ গল্প। আসল সাফল্য হলো যখন আপনি ডিগ্রির পাশাপাশি সঙ্গে করে নিয়ে বের হন অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার, বন্ধুত্বের নেটওয়ার্ক, নেতৃত্বের গল্প আর নিজের বিকশিত ব্যক্তিত্ব। কারণ শেষ পর্যন্ত, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনটা শুধু শেখার নয়, নিজেকে জানারও যাত্রা। আর সেই যাত্রায় সহশিক্ষা কার্যক্রমই সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সঙ্গী।
তাই বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের শুরুতে যে শিক্ষার্থীরা ভাবে, ‘পড়াশোনা আর ডিগ্রি পেলেই সব হয়ে যাবে’, তাদের জন্য একটি কথাÑ শুধু ক্লাসে বসে বই পড়লে আপনি হয়তো ‘তত্ত্বে’ শক্ত হবেন, কিন্তু মাঠে না নামলে বাস্তব জীবনে ব্যবহারের সুযোগ হারাবেন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হওয়ার দিন হাতে শুধু ডিগ্রি নয়, বরং অভিজ্ঞতার বোঝা, বন্ধু ও সহকর্মীর নেটওয়ার্ক, আর নিজের বিকশিত ব্যক্তিত্বÑ এই সব নিয়ে বের হওয়াটাই আসল সাফল্য। আর এই সাফল্যের বড় অংশটাই গড়ে ওঠে সহশিক্ষা কার্যক্রমের মাঠে। ত্ত
আরও পড়ুন:
ইবিতে শীতের আগমনী বার্তা
জ্যেষ্ঠ প্রভাষক, যোগাযোগ ও গণমাধ্যম বিভাগ
ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভ