চায়না কোম্পানি হেক্সিংয়ের সঙ্গে ব্যবসা সম্পর্ক নয়
প্রিপেইড মিটারের দুর্নীতি
বিদ্যুৎ খাতে সিস্টেম লস কমিয়ে আনা এবং গ্রাহকের বিদ্যুৎ বিল পরিশোধে আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে যুক্ত হতে গত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ওজোপাডিকো) এবং একটি চায়না কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি হয়। দুটি কোম্পানি মিলে একটি বৈদ্যুতিক প্রিপেইড মিটার তৈরির কোম্পানি গঠন করে। লক্ষ্য ছিল- দেশেই প্রিপেইড মিটার তৈরি করে গ্রাহককে সরবরাহ করা। কিন্তু শুরু থেকেই এই কোম্পানির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে, যা তদন্তে গত জানুয়ারিতে তিন সদস্যের একটি কমিটি করে অন্তর্বতী সরকার। মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্তি সচিব আলী রেজাকে প্রধান করে গঠিত কমিটি তদন্ত শেষে দুর্নীতি ও অনিয়মের সত্যতা পেয়েছে। ফলে বিগত সময়ে প্রিপেইড মিটার খাতে দায়েরকৃত দুর্নীতির অভিযোগ থেকে খালাসের যে প্রক্রিয়া চলছে, সেটা স্থগিত রাখার সুপারিশ করেছে কমিটি। একই সঙ্গে অভিযুক্ত চীনা কোম্পানির সঙ্গে দেশে বিদ্যুৎ বিতরণের সঙ্গে যুক্ত ছয়টি কোম্পানিকে কোনো ব্যবসায়িক সম্পর্কে না জড়ানোর নির্দেশনা দিয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দেশের বিদ্যুৎ খাতকে ডিজিটাল করতে ভিশন-২০২১ এর আওতায় স্মার্ট প্রিপেইড মিটার সংযোজনের উদ্যোগ নেয় বিগত সরকার। এরই অংশ হিসেবে দেশীয় ব্যবস্থাপনায় প্রিপেইড মিটার উৎপাদনের লক্ষ্য ২০১৮ সালের ১৮ ডিসেম্বর জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন খুলনায়
বাংলাদেশ স্মার্ট ইলেকট্রিক্যাল কোম্পানি লিমিটেড (বিএসইসিও) নামে একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করা হয়। সরকারি মালিকানাধীন ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড ও চীনের হেক্সিং ইলেকট্রিক্যাল কোম্পানি লিমিটেড জয়েন্ট ভেঞ্চারে এই কোম্পানি গঠন করে।
মিটার তৈরির দায়িত্ব পায় বাংলাদেশ স্মার্ট ইলেকট্রিক্যাল কোম্পানি (বেসিকো)। দেশীয় মালিকানাধীন কোম্পানির ওজোপাডিকোর শেয়ার ৫১ শতাংশ আর চীনা কোম্পানির শেয়ার ধরা হয় ৪৯ শতাংশ। কিন্তু কোম্পানি গঠনের পর থেকেই চীনা কোম্পানির বিরুদ্ধে গুরুতর অনিয়মের অভিযোগ উঠে। ফলে এক বছরের মাথায় কোম্পানিটি বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয় তৎকালীন পরিচালনা পর্ষদ। ওই সময়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে কোম্পানিটির দুর্নীতির খবর প্রকাশিত হয়। স্মার্ট প্রিপেইড মিটারের নামে বিদ্যুৎ খাতের ৪২৬ কোটি টাকার দুর্নীতির বিষয়টি সামনে আসে। মামলা হয় দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক)। সেই মামলা থেকে মুক্তির প্রক্রিয়াও চলমান আছে বলে জানা যায়। তবে অন্তর্বর্তী সরকার নতুন করে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তে একটি কমিটি করে। ওই কমিটি দুর্নীতির সত্যতা পেয়ে বিদ্যুৎ বিভাগে কিছু সুপারিশ দিয়েছে।
আরও পড়ুন:
আকতার পারভেজ সর্বোচ্চ ভোটে সিএসই পরিচালক
বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, তদন্ত গঠিত কমিটি হেক্সিংয়ের বিষয়ে দুটি সুপারিশ করেছে, যার মধ্যে রয়েছে- ভুয়া বিলের মাধ্যমে অর্থ পাচারের সুনির্দষ্ট অভিযোগ হতে হেক্সিংকে অব্যাহতির সুপারিশ প্রদান করায় ও এরই মধ্যে ওজোপাডিকো কর্তৃক সব মামলা তুলে নেওয়া এবং দুদকের অভিযোগ প্রত্যাহারের প্রক্রিয়া স্থগিত করতে হবে। সেটা বাস্তবায়ন করবে ওজোপাডিকো; এ ছাড়া প্রিপেইড মিটার প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান হেক্সিং ভারত, নেপাল, ও কেনিয়াসহ অনেক দেশে কালো তালিকাভুক্ত হওয়ায় এবং বিতর্কিত কর্মকাণ্ড ও দুর্নীতিতে জড়িত থাকার কারণে হেক্সিংয়ের সঙ্গে কোনো প্রকার লেনদেন ও ব্যবসায়িক সম্পর্ক স্থাপনে সতর্ক থাকতে হবে। বিদ্যুৎ বিতরণের ছয়টি কোম্পানির প্রতি এ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
সূত্র জানায়, ২০২৩ সালে দুদকের একটি দল অভিযান চালিয়ে বিদ্যুৎ খাতের ৩৩ কোটি ৪০ লাখ ২৪ হাজার ৩৭৯ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে তিনজনের বিরুদ্ধে মামলা করেছিল। মামলার আসামিরা ছিলেন- ওজোপাডিকোর সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শফিক উদ্দিন, সাবেক কোম্পানি সচিব আব্দুল মোতালেব এবং বাংলাদেশ স্মার্ট ইলেকট্রিক্যাল কোম্পানির সাবেক উপব্যবস্থাপনা পরিচালক ইয়ে ওয়েনজুন।
২০২৩ সালের মে মাসে দুদকের খুলনায় কার্যলয়ে সহকারী পরিচালক তরুণ কান্তি ঘোষ বাদী হয়ে মামলাটি করেছিলেন। জানা যায়, দেশের বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনা উন্নত করার প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে প্রিপেইড মিটার উৎপাদন, বাজারজাত ও প্রশিক্ষণের প্রকল্প নেয় সরকার। ওই প্রকল্পের ৩৩ কোটি ৪০ লাখ ২৪ হাজার ৩৭৯ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে এই মামলা করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৪০৯/১০৯ ধারাসহ ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন ৫ (২) ধারা ও মানিলন্ডারিং আইন ২০১২ এর ৪(২) ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছিল।
আরও পড়ুন:
বৃহত্তম হিমশৈল
দুদকের তদন্ত প্রতিবেদনের তথ্য মতে, আসামিরা ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতির মাধ্যমে এলসি করে হেক্সিং ইলেকট্রিক্যাল কোম্পানি কোনো প্রশিক্ষণ না দিয়ে ১৮ লাখ ৬৫ হাজার ৭৮৮ টাকা, রিপেয়ার ট্রেনিং বাবদ ৬ লাখ ৯৯ হাজার ৬৭০ টাকা, প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড টেকনিক্যাল সাপোর্ট সার্ভিস খাতের ৫ কোটি ৫২ লাখ ১৭ হাজার ৫০০ টাকা, তিন বছরের ওয়ারেন্টি মিটারের জন্য বরাদ্দকৃত ৭ কোটি ২১ লাখ ৩২ হাজার ২৩৮ টাকা এবং প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড টেকনিক্যাল সাপোর্ট সার্ভিসের ১ কোটি ২৯ লাখ ৯৭ হাজার ৩৫০ টাকাসহ বিভিন্ন খাতের ৩৩ কোটি ৪০ লাখ ২৪ হাজার ৩৭৯ টাকা আত্মসাৎ করেছে।
বিএসইসিও’র কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিদেশে প্রশিক্ষণের জন্য ৩ লাখ ৫০ হাজার ইউএস ডলার রাখা হয়। কিন্তু কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীকে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়নি। অন্যদিকে বিএসইসিও’র ডিএমডি ইয়ে ওয়েনজুন এবং পরিচালক আব্দুল মোতালেব হেক্সিং ইলেকট্রিক্যাল কোম্পানির দাবির পরিপ্রেক্ষিতে এলসির সব ডকুমেন্ট প্রদান করা হয়। ফলে হেক্সিং ইলেকট্রিক্যালে বৈদেশিক প্রশিক্ষণ বাবদ এলসিতে উল্লেখিত ৩ লাখ ৫০ হাজার ডলার প্রাপ্তির সুযোগ তৈরি হয়।
আরও পড়ুন:
কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম