কাটছে না অর্থনীতির গতিহীনতা
চলমান বৈশ্বিক অস্থিরতা, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, ব্যাংক খাতের দুর্বলতা এবং বিনিয়োগ প্রবাহে স্থবিরতার কারণে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি চাপে রয়েছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের প্রচেষ্টা থাকলেও সেপ্টেম্বর মাসে তা আবার বেড়ে হয়েছে ৮ দশমিক ৩৬ শতাংশ। একই সময়ে রপ্তানি আয় কমেছে, দারিদ্র্য ও বেকারত্ব বেড়েছে এবং ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ নতুন রেকর্ড ছুঁয়েছে। এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের পরবর্তী কিস্তি নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। এতে অর্থনীতির ভবিষ্যৎ গতি আরও ঝুঁকির মুখে পড়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
জানা গেছে, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর দেশে বহু কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এতে বিপুল মানুষ কাজ হারিয়েছেন। সেই সঙ্গে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি কমে যাওয়ায় পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাসীন সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার ‘বৈষম্যহীন ও টেকসই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ার প্রত্যয়’ নিয়ে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করে। প্রবৃদ্ধি সহায়কতার রীতি ভেঙে সে সময় নতুন বাজেটকে ঘোষণা করা হয়েছিল মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের বাজেট। তবে প্রবৃদ্ধির গতিপ্রবাহ বজায় রেখে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের যে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল, তা প্রথম তিন মাসেই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।
সেপ্টেম্বরে সাধারণ মূল্যস্ফীতি ৮ দশমিক ৩৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যা আগস্টে ছিল ৮ দশমিক ২৯ শতাংশ। শুধু তাই নয়, অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে টানা রপ্তানি আয় কমেছে ৪.৬১ শতাংশ। মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি তো অনেক আগে থেকেই তলানিতে বিরাজ করছে। যার ফলে বাড়ছে না কর্মসংস্থান। বরং বেকারত্ব ও দারিদ্র্যের বোঝা বাড়ছে। বিভিন্ন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের জরিপ বলছে, প্রতিবছর ৩ শতাংশের বেশি হারে দারিদ্র্য বাড়ছে। বর্তমানে দেশের অন্তত ২৮ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে। সমাজে আরও প্রকট আকার ধারণ করেছে মানুষের আয়বৈষম্য। এতে করে সামষ্টিক অর্থনীতি অনেকটা লক্ষ্যহীন পথেই এগিয়ে চলছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। অন্যদিকে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছেÑ ৫ লাখ কোটি টাকা। অনিয়মে ডুবতে থাকা পাঁচটি ব্যাংকের একীভূতকরণ প্রক্রিয়া নিয়ে তৈরি হয়েছে ধূম্রজাল। এতে গ্রাহকদের মাঝে বিরাজ করছে গচ্ছিত টাকা হারানোর আতঙ্ক। ২২ বছরের সর্বনিম্ন পর্যায়ে চলে গেছে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবৃদ্ধি। ফলে সামগ্রিকভাবে বাধগ্রস্ত হচ্ছে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি।
প্রবৃদ্ধিতে ধীরগতি, বিনিয়োগে স্থবিরতা : প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার মূল কারণ বিনিয়োগ প্রবাহে সংকোচন। নতুন প্রকল্প ও শিল্পপ্রতিষ্ঠান কম স্থাপিত হওয়ায় কর্মসংস্থানের সুযোগও কমছে। ফলাফল হিসেবে শ্রমবাজারে কর্মহীনতার চিত্র স্পষ্ট হচ্ছে। বিশ্বব্যাংকও তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, ব্যবসায়িক পরিবেশের অবনতি, দুর্বল আইনশৃঙ্খলা ও কর্মসংস্থানের সীমাবদ্ধতার কারণে অনেকেই শ্রমবাজার থেকে সরে যেতে বাধ্য হয়েছেন।
আরও পড়ুন:
আকতার পারভেজ সর্বোচ্চ ভোটে সিএসই পরিচালক
তিন মাসে রাজস্ব আহরণে ঘাটতি ৯ হাজার কোটি টাকা : চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) সার্বিকভাবে শুল্ক ও কর আদায়ে ঘাটতি হয়েছে ৮ হাজার ৮৯৯ কোটি টাকা। এনবিআরের হিসাব অনুসারে, গত জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ছিল ৯৯ হাজার ৯০৪ কোটি টাকা। এর বিপরীতে আদায় হয়েছে ৯১ হাজার ৫ কোটি টাকা। এ সময়ে রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি হয়েছে প্রায় সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা।
বেকারত্ব ও দারিদ্র্যের ঊর্ধ্বগতি : তিন বছরের ব্যবধানে দেশে দারিদ্র্য বেড়েছে ১০ শতাংশের মতো। দেশে এখন দারিদ্র্যের হার প্রায় ২৮ শতাংশ। ২০২২ সালে এই হার ছিল ১৮ দশমিক ৭। এর বাইরে ১৮ শতাংশ পরিবার দারিদ্র্যসীমায় নেমে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। যে কোনো সময় দারিদ্র্যসীমায় নেমে যেতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে বিভিন্ন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) জানায়, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে বেকারত্ব বেড়ে হয়েছে ৪ দশমিক ৬৩ শতাংশ; বেকারের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৭ লাখে। নারীদের শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণ কমে যাওয়ায় এ হার আরও উদ্বেগজনক। একই সময় জিডিপি প্রবৃদ্ধি নেমে এসেছে ৩.৯৭ শতাংশে, যা কোভিডকাল বাদ দিলে গত দুই দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, প্রতিবছর প্রায় ৩ শতাংশ হারে দারিদ্র্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। অন্যদিকে চলতি অর্থবছর (২০২৫-২৬)-এর প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নের হার গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় কিছুটা বেড়েছে। তবে এ সময়ে ব্যয় কমেছে ১ হাজার ৫৭ কোটি টাকা।
কমেছে রপ্তানি আয়, বেড়েছে মূল্যস্ফীতি : অর্থনীতির নানা সংকট সত্ত্বেও কিছুটা স্থিতিশীল ছিল রপ্তানি আয়, কিন্তু এবার সেই আশা ভাঙতে শুরু করেছে।
আরও পড়ুন:
বৃহত্তম হিমশৈল
সেপ্টেম্বর মাসে রপ্তানি আয় গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৪ দশমিক ৭৩ শতাংশ কমেছে। প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাকশিল্পে অর্ডার কমে যাওয়ায় সামগ্রিক আয় হ্রাস পেয়েছে। অন্যদিকে খাদ্য মূল্যস্ফীতি সেপ্টেম্বর মাসে দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৬৪ শতাংশ এবং খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি ৮ দশমিক ৯৮ শতাংশ। তিন বছর ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতি দেশের মানুষের প্রকৃত আয় কমিয়ে দিচ্ছে।
আইএমএফ কিস্তি অনিশ্চিত, আশঙ্কা আরও বাড়ছে : নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় না আসা পর্যন্ত চলমান ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের আগামী কিস্তির অর্থ ছাড় করবে না আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর যে রাজনৈতিক সরকার আসবে, তারা আইএমএফের ঋণের শর্ত মানবে কি না, সেই নিশ্চয়তা না পেয়ে কিস্তির অর্থ ছাড় করতে রাজি নয় সংস্থাটি। ওয়াশিংটনে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের বার্ষিক সম্মেলনে বাংলাদেশকে এমন বার্তা দেওয়া হয়েছে বলে সম্মেলনে অংশ নেওয়া অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর সেখানে সাংবাদিকদের জানান।
প্রসঙ্গত এ পর্যন্ত চলমান এ ঋণ কর্মসূচির ৫টি কিস্তির অর্থ ছাড় করা হয়েছে। ঋণের ষষ্ঠ কিস্তি ছাড় করার আগে পূর্ব নির্ধারিত সময়সূচি অনুযায়ী আগামী ২৯ অক্টোবর আইএমএফ প্রতিনিধি দলের ঢাকায় আসার কথা রয়েছে। সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে চলতি বছরের ডিসেম্বর শেষে কিংবা আগামী জানুয়ারির প্রথমার্ধে ঋণের ষষ্ঠ কিস্তি ছাড় করার কথা ছিল।
আরও পড়ুন:
কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ : অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, আমাদের মুদ্রানীতিতে পরিবর্তন আনতে হবে। সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। এতে একদিকে বিনিয়োগ সংকুচিত হয়, অন্যদিকে কর্মসংস্থান তৈরি হয় না। বিনিয়োগের পরিবেশ তৈরি করতে হবে। আশা করি, আগামী সরকার বিষয়টি বুঝবে।