শিক্ষকদের দাবির তোড়ে নাস্তানাবুদ মন্ত্রণালয়
বাড়িভাড়া ভাতা বাড়ানোর দাবিতে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের টানা ১০ দিনের আন্দোলন শেষ হতেই এবার জাতীয়করণের দাবিতে রাজপথে নেমেছেন স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসার শিক্ষকরা। এর আগে, গত সেপ্টেম্বরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের দাবিতে রাজপথে নেমেছিল শিক্ষক-কর্মচারী ঐক্যজোট। এরও আগে গত জুন-জুলাইয়ে এমপিওভুক্তির দাবিতে নন-এমপিও শিক্ষকরা আন্দোলনে নেমেছিলেন। গত মার্চে শতভাগ উৎসব ভাতার দাবিতে মাঠে নেমেছিলেন এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা। গত বছরের আগস্টে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত বিভিন্ন দাবি-দাওয়া আদায়ে রাজপথে আন্দোলন করতে দেখা গেছে শিক্ষকদের। এমনকি শিক্ষার্থীরাও বিভিন্ন দাবিতে পথে নেমেছেন। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের একের পর এক আন্দোলনে কার্যত নাস্তানাবুদ অবস্থায় পড়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
প্রশাসনিক রুটিন কার্যক্রমের চেয়ে এখন দাবি-দাওয়া মোকাবেলাতেই ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষা উপদেষ্টা ড. সি আর আবরার। আর এসব দাবির সঙ্গে আর্থিক সংশ্লেষ থাকায় প্রতিটি সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রেই কালক্ষেপণ হচ্ছে; উপদেষ্টাকে তাকিয়ে থাকতে হচ্ছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের দিকে। ফলে এক আন্দোলন স্তিমিত হওয়ার আগেই আরেকটি আন্দোলন দানা বাঁধছে, যা সরকারের জন্য নতুন অস্থিরতার ইঙ্গিত দিচ্ছে।
সাক্ষাৎ প্রত্যাখ্যান করায় শিক্ষা উপদেষ্টার ওপর ক্ষুব্ধ শিক্ষকরা স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসার শিক্ষকরা গতকাল বুধবার জাতীয়করণের দাবিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে স্মারকলিপি দিতে গেলে শিক্ষা উপদেষ্টা তাঁদের সঙ্গে সাক্ষাতে অস্বীকৃতি জানান। এতে ক্ষুব্ধ শিক্ষকরা ‘অপমানজনক আচরণ’র অভিযোগ তুলে শিক্ষা উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি করেন। তাঁরা আজ বৃহস্পতিবার বেলা ১১টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশের নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন।
গতকাল সকালে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে ‘স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা শিক্ষক ঐক্যজোট আন্দোলন বাস্তবায়ন কমিটি’র ব্যানারে অবস্থান কর্মসূচি শুরু হয়। বিভিন্ন জেলা থেকে আগত শিক্ষকরা হাতে প্ল্যাকার্ড ও ব্যানার নিয়ে সেখানে জড়ো হন। ব্যানারে লেখা ছিলÑ ‘প্রাইমারি জাতীয়করণ, আমরা কেন বিনা বেতন?’; ‘সরকার আসে সরকার যায়, ইবতেদায়ি শিক্ষক বিনা বেতনে কেন মারা যায়?’; ‘দান অনুদান নয়, সাংবিধানিক অধিকার চাই’ ইত্যাদি। দুপুরের পর শিক্ষকরা মন্ত্রণালয়ের উদ্দেশে পদযাত্রা শুরু করলে পুলিশ প্রেসক্লাবের সামনে ব্যারিকেড দেয়। সরেজমিন দেখা যায়, পুলিশের জলকামান ও রায়ট কার প্রস্তুত। অন্যদিকে শিক্ষকরা সড়কে বসেই সেøাগান দিতে থাকেন- ন্যায়বিচার চাই, জাতীয়করণ চাই। ফলে প্রেসক্লাব-পল্টন এলাকায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। এ ছাড়া যান চলাচল বন্ধ হয়ে সৃষ্টি হয় তীব্র যানজট।
স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা শিক্ষক ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান কাজী মোখলেছুর রহমান বলেন, আমরা শিক্ষক, ভিক্ষুক নই। রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে ন্যায্য অধিকার চাইছি। অথচ আমাদের সঙ্গে এমন আচরণ করা হয়েছে, যেন আমরা অবাঞ্ছিত। শিক্ষা উপদেষ্টার এ আচরণ শুধু আমাদের নয়, গোটা শিক্ষক সমাজের প্রতি অপমান। তিনি আরও বলেন, আমরা শান্তিপূর্ণভাবে স্মারকলিপি দিতে গিয়েছিলাম। সাক্ষাৎ না করে আমাদের অবজ্ঞা করা হয়েছে। আমরা শিক্ষা উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি করছি এবং জাতীয়করণের সুনির্দিষ্ট ঘোষণা না আসা পর্যন্ত রাজপথ ছাড়ব না।
আরও পড়ুন:
হরতাল-অবরোধে শীতের পোশাক ব্যবসায় মন্দা
সংগঠনের সদস্য সচিব মাওলানা আল আমিন বলেন, আজকের ঘটনা আমাদের গভীরভাবে আহত করেছে। শিক্ষা উপদেষ্টা যদি দ্রুত পদত্যাগ না করেন এবং জাতীয়করণের প্রক্রিয়ার ঘোষণা না হয়, তবে আমরা অনশনসহ কঠোর কর্মসূচিতে যাব।
১৫ হাজার শিক্ষক অনিশ্চয়তায়
শিক্ষক ঐক্যজোটের তথ্য মতে, দেশের বিভিন্ন জেলায় ১৫ হাজারেরও বেশি শিক্ষক দীর্ঘদিন ধরে বিনা বেতন বা অল্প সম্মানীতে কর্মরত আছেন। অধিকাংশ মাদ্রাসায় মাসিক সম্মানী ২ থেকে ৩ হাজার টাকার বেশি নয়। এতে শিক্ষকরা চরম অর্থকষ্টে দিন পার করছেন। কেউ বিকল্প জীবিকার সন্ধান করছেন, কেউ ঋণের জালে জর্জরিত।
ময়মনসিংহ থেকে আসা শিক্ষক মো. নূরুল আমিন বলেন, আমরা প্রাথমিক শিক্ষার মূলভিত্তি তৈরি করছি, কিন্তু সরকারের কাছে বারবার বঞ্চিত হচ্ছি। জাতীয়করণের ঘোষণা এলেও বাস্তবায়ন হয়নি। সংসার চালানোই এখন দায় হয়ে পড়েছে।
আরও পড়ুন:
আকতার পারভেজ সর্বোচ্চ ভোটে সিএসই পরিচালক
শিক্ষক রেজাউল হক বলেন, আমরা কোনো অনুদান চাই না, সরকারি শিক্ষকদের মতো মর্যাদা চাই। প্রয়োজনে রাজপথেই জীবন দেব।
পাঁচ দফা দাবি
স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা শিক্ষক ঐক্যজোটের পাঁচ দফা দাবি হচ্ছেÑ এক. চলতি বছরের ২৮ জানুয়ারি ঘোষিত জাতীয়করণ সিদ্ধান্ত দ্রুত বাস্তবায়ন করা; দুই. কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ প্রেরিত ১ হাজার ৮৯ প্রতিষ্ঠানের এমপিও ফাইল অনুমোদন দেওয়া; তিন. অনুদানবিহীন স্বীকৃত মাদ্রাসাগুলোর জন্য নতুন এমপিও বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা; চার. প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মতো প্রাক-প্রাথমিক পদ সৃষ্টি করা এবং পাঁচ. স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসার জন্য পৃথক অধিদপ্তর গঠন করা।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেছেন, সরকার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েছে, পর্যায়ক্রমে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। কিন্তু আন্দোলনরত শিক্ষকরা বলেছেন, আমরা আশ্বাসে নয়, বাস্তবায়নে বিশ্বাসী।
আরও পড়ুন:
বৃহত্তম হিমশৈল
চট্টগ্রাম অঞ্চলের শিক্ষক জাকির হোসেন বলেন, ইবতেদায়ি শিক্ষা ইসলামী মূল্যবোধ গঠনের প্রথম ধাপ। এই শিক্ষকরা অবহেলিত থাকলে শিক্ষা কাঠামোও বিপর্যস্ত হবে।
এ প্রসঙ্গে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ এক কর্মকর্তা বলেন, একের পর এক আন্দোলনের কারণে মন্ত্রণালয়ে প্রশাসনিক রুটিন কার্যক্রমের চেয়ে এখন দাবি-দাওয়া মোকাবিলাতেই ব্যস্ত সময় কাটাতে হচ্ছে শিক্ষা উপদেষ্টাকে। এসব দাবির সঙ্গে আর্থিক সংশ্লেষ থাকায় একা সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না। ফলে দুই মন্ত্রণালয়ে দৌড়ঝাঁপে ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে।
একদিকে শিক্ষক সমাজের ক্ষোভ, অন্যদিকে প্রশাসনের নীরবতা এর মাঝে আটকে আছে হাজারো শিক্ষকের জীবিকা, আর একটি জাতীয় প্রতিশ্রুতির অপূর্ণ বাস্তবায়ন। একের পর এক শিক্ষক আন্দোলনে তাই ক্রমেই কোণঠাসা হয়ে পড়ছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।