পূবালী ব্যাংকে বিনিয়োগের অর্থ ফেরত পায়নি সোনালী

আবু আলী
২২ অক্টোবর ২০২৫, ০৮:০০
শেয়ার :
পূবালী ব্যাংকে বিনিয়োগের অর্থ ফেরত পায়নি সোনালী

রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক পিএলসি পূবালী ব্যাংকে করা স্বাধীনতাপূর্ব বিনিয়োগের অর্থ আজও বুঝে পায়নি। দেশের ব্যাংকিং ইতিহাসে নজিরবিহীন এই ঘটনা টানা ৬৬ বছর ধরে প্রশাসনিক জটিলতায় ঝুলে আছে। একদিকে সময়ের ঘূর্ণি বদলে দিয়েছে প্রজন্ম, অন্যদিকে এখনও অনিশ্চিত রয়ে গেছে রাষ্ট্রীয় এই বিনিয়োগের চূড়ান্ত নিষ্পত্তি। বিষয়টি শুধু আর্থিক নয়, বরং নীতিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক দায়বদ্ধতার প্রশ্নও উত্থাপন করেছে।

৬৬ বছর আগে পূবালী ব্যাংকে করা বিনিয়োগ বুঝে পায়নি রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক পিএলসি। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি সোনালী ব্যাংক পিএলসি পূবালী ব্যাংকে তাদের স্বাধীনতাপূর্ব বিনিয়োগসংক্রান্ত দাবি নিষ্পত্তির জন্য নতুন করে অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ বিষয়টি পুনরায় অর্থ মন্ত্রণালয়ের সচিব কাছে চিঠি পাঠিয়েছে।

জানা গেছে, দেশের ব্যাংকিং ইতিহাসে এই বিনিয়োগ দাবি একটি নজিরবিহীন দীর্ঘ প্রশাসনিক বিতর্কে পরিণত হয়েছে। প্রায় ৬৬ বছর পরও স্বাধীনতাপূর্ব বিনিয়োগের এই আর্থিক দায়-দাবি আজও অমীমাংসিত। সরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে এই ধরনের স্থায়ী জট শুধু আর্থিক নয়, বরং নীতিগত প্রশ্নও উঠেছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, রাষ্ট্রীয় সম্পদের দায়ভার কতদিন এমনভাবে অনিশ্চিত অবস্থায় পড়ে থাকবে?

জানা গেছে, ১৯৫৯ সালে তদানীন্তন ইস্টার্ন মার্কেন্টাইল ব্যাংক লিমিটেড প্রতিষ্ঠার সময় সরকারি খাতের কয়েকটি ব্যাংক মূলধন বিনিয়োগ করে। সোনালী ব্যাংক (তখন ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান) তখন ওই ব্যাংকের ৩৮ হাজার ৩৩৫টি শেয়ারে বিনিয়োগ করে, যা পরবর্তীতে ১৯৬৮, ১৯৬৯ ও ১৯৭০ সালের ১০:১ বোনাসের মাধ্যমে ৫১ হাজার ২২টি শেয়ারে উন্নীত হয়। প্রতিটি শেয়ারের মূল্য ১০ টাকা হিসেবে সোনালী ব্যাংকের মোট বিনিয়োগ দাঁড়ায় ৫ লাখ ১০ হাজার ২২০ টাকা।

দীর্ঘ স্থবিরতার পর ২০১৬ সালের ২৫ অক্টোবর ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. ফজলুল হকের সভাপতিত্বে আবার একটি সভা হয়। সেখানে সোনালী ব্যাংকের প্রতিনিধিরা স্বাধীনতাপূর্ব বিনিয়োগের আসল ও লভ্যাংশসহ সব পাওনা পরিশোধের দাবি পুনরায় উত্থাপন করেন।

সেই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, সোনালী ব্যাংক দাবির পক্ষে দলিল ও প্রমাণাদিসহ লিখিত বক্তব্য দেবে। পূবালী ব্যাংক বিক্রেতা চুক্তি ও প্রাসঙ্গিক নথি জমা দেবে। উভয় ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করে বিষয়টি আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। প্রয়োজনে আদালতের মাধ্যমে নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেওয়া হবে।

ওই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য সোনালী ব্যাংক ২০১৭ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি তাদের প্রথম লিখিত বক্তব্য দাখিল করে। পরবর্তী সময়ে ২০১৭ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ব্যাংকটি ৯ দফায় (২৬ জুলাই ২০১৭, ৩ জানুয়ারি ২০১৮, ১০ জুলাই ২০১৮, ১৮ ডিসেম্বর ২০১৮, ২৩ এপ্রিল ২০১৯, ৯ ডিসেম্বর ২০১৯, ২ ডিসেম্বর ২০২০, ৪ এপ্রিল ২০২২ ও ১৪ নভেম্বর ২০২৩) অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠায়।

কিন্তু এসব চিঠির কোনো কার্যকর জবাব বা পদক্ষেপ সম্পর্কে ব্যাংকটি এখনও অবহিত হয়নি। এমনকি পূবালী ব্যাংককেও ২০২৪ সালের ৮ ডিসেম্বর (পত্র নম্বর ১৭২৭) চিঠি দেওয়া হলেও তাদের পক্ষ থেকেও কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।

অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, স্বাধীনতাপূর্ব বিনিয়োগ নিয়ে দুই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের এই দীর্ঘ আইনি ও প্রশাসনিক জট শুধু আর্থিক দায় নয়, বরং এটি প্রাতিষ্ঠানিক সমন্বয়ের দুর্বলতারও প্রতিফলন। সরকারি ব্যাংকগুলোর তহবিল বিনিয়োগের হিসাব নিরসনে স্বচ্ছতার ঘাটতি এবং মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতা এই ধরনের পুরনো দাবিকে অনিরসিত রেখেছে।

সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শওকত আলী খান তাঁর সর্বশেষ চিঠিতে উল্লেখ করেছেনÑ স্বাধীনতাপূর্ব ইস্টার্ন মার্কেন্টাইল ব্যাংক লিমিটেডে সোনালী ব্যাংকের বিনিয়োগ বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। সেই বিনিয়োগের স্বীকৃতি ও দাবি নিষ্পত্তি উভয় ব্যাংকের জন্যই অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি অনুরোধ জানিয়েছেন, ইতোপূর্বে গৃহীত সিদ্ধান্ত মোতাবেক দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে বিষয়টির চূড়ান্ত নিষ্পত্তি করা হোক।