সিদ্ধান্তে কালক্ষেপণে শঙ্কা হাজার টন পণ্য নষ্টের

গোলাম সাত্তার রনি
২২ অক্টোবর ২০২৫, ০৭:১২
শেয়ার :
সিদ্ধান্তে কালক্ষেপণে শঙ্কা হাজার টন পণ্য নষ্টের

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অগ্নিকাণ্ডের পর নতুন কার্গো হাউসের সংকটে খোলা আকাশের নিচে প্রতিদিন জমা করা হচ্ছে বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানীকৃত মূল্যবান সব পণ্য। সরকার সিদ্ধান্ত নিতে কালক্ষেপণ করায় থার্ড টার্মিনালের ইমপোর্ট কার্গো টার্মিনাল সহসাই ব্যবহার উপযোগী হচ্ছে না। অন্যদিকে নতুন করে কার্গো হাউস তৈরি করতে লাগবে অন্তত ছয় মাস। প্রতিদিন বিদেশ থেকে আসা হাজার টন পণ্য খোলা আকাশের নিচে থাকায় রোদ-বৃষ্টিতে নষ্টের শঙ্কা তৈরি হয়েছে। ওষুধের কাঁচামালসহ আমদানীকৃত অনেক পণ্যের মান কমে যাওয়ার শঙ্কাও দেখা দিয়েছে। এরই প্রেক্ষিতে আমদানি পণ্যের হেফাজতে দ্রুত গুদাম চেয়ে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষকে (বেবিচক) চিঠি দিয়েছে ঢাকা কাস্টম হাউস।

এদিকে, কার্গো হাউসে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর এ বিষয়ে নতুন করে সতর্কতা জারি করেছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের প্রকৌশল শাখা।

বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মোস্তফা মাহমুদ সিদ্দিক বলেন, অগ্নিকাণ্ডের পর ওয়্যারহাউস নিয়ে আমরা কিছুটা সমস্যায় আছি। নতুন ওয়ারহাউসের টাকা নিয়ে ঠিকাদারের সঙ্গে কথা হচ্ছে। তাদের পাওনার পরিমাণ বেশি হওয়ায় জটিলতা তৈরি হয়েছে। এর পরও আমরা চেষ্টা করছি বিষয়টি দ্রুত সমাধানের। পাশাপাশি সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়েও বিষয়টি নিয়ে সর্বক্ষণিক আলোচনা হচ্ছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদেশ থেকে আমদানীকৃত মালামাল কোথায় রাখা হবে, এ নিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছে বেবিচক, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ও কাস্টম হাউস। নতুন ওয়্যারহাউস থাকলেও তা

সহসাই চালু করা যাচ্ছে না। ঠিকাদারের পাওনা প্রায় এক হাজার কোটি টাকা নিয়ে তৈরি হয়েছে জটিলতা। বকেয়া অর্থ না দিলে বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনালের নবনির্মিত কার্গো হাউস হস্তান্তর না করার বিষয়ে বেঁকে বসেছেন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। ওই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে বেবিচক। নতুন ওয়্যারহাউসে নেই উন্নতমানের স্ক্যানারসহ অন্যান্য যন্ত্রপাতি। গত চার দিনে ওয়্যারহাউসের সমস্যার কারণে খোলা আকাশের নিচে জমা হয়েছে প্রায় ২ হাজার টন পণ্য।

এদিকে দ্রুত ওয়্যারহাউস চেয়ে গতকাল কাস্টমস কর্তৃপক্ষ চিঠি দিয়েছে বেবিচক চেয়ারম্যান বরাবর। পাশাপাশি স্টেশন ম্যানেজারসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের উড়োজাহাজগুলো নিয়মিত পরীক্ষা-নিরীক্ষার পাশাপাশি অগ্নিকাণ্ডের বিষয়ে সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের প্রকৌশল বিভাগ।

সংশ্লিষ্টরা জানান, অগ্নিকাণ্ডে কার্গো হাউস পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়ায় এখন অন্তত ২ হাজার টন পণ্য খোলা আকাশের নিচে পড়ে আছে। এ নিয়ে বেবিচক অসন্তোষ প্রকাশ করলেও কার্যত সমস্যাটির সুরাহা করতে পারছে না। পাশাপাশি আমদানি পণ্য সাময়িকভাবে রাখার জন্য যে নতুন স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে, সেখানেও আধুনিক স্ক্যানার মেশিনের অভাব রয়েছে। স্ক্যানার মেশিনের অভাবে পণ্য খালাস প্রক্রিয়া চলছে ধীরগতিতে। কায়িক পরীক্ষার মাধ্যমে শুল্কায়ন করতে অনেক বেশি সময় লাগছে, যা আমদানিকারকদের ভোগান্তি আরও বাড়াচ্ছে। সবচেয়ে বড় উদ্বেগের কারণ হলো আমদানি করা কোটি কোটি টাকার মূল্যবান পণ্যসামগ্রী (তৈরি পোশাক ও ওষুধের কাঁচামাল, ইলেকট্রনিক পণ্য ইত্যাদি) এখন খোলা আকাশের নিচে রাখা হয়েছে। সংশ্লিষ্টদের আশঙ্কা, যে কোনো সময় বৃষ্টি হলে এসব পণ্যের বড় ধরনের ক্ষতি হবে, যা দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য এবং অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। ছোট ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রে এ ক্ষতি আরও মারাত্মক আকার ধারণ করবে।

বিমান পরিচালনা পরিষদের সাবেক সদস্য ও এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহেদুল আলম আমাদের সময়কে বলেন, থার্ড টার্মিনাল নির্মাণের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নিশ্চয় যুক্তিসঙ্গতভাবে টাকা দাবি করছে। যদি এক হাজার কোটি টাকা পাওনা থাকে, তা হলে দুই পক্ষ বসে এর সমাধান করতে হবে। সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করতে হবে। প্রয়োজনের সময় প্রস্তুত কার্গো হাউস ব্যবহার করতে না পারা আমাদের জন্যই ক্ষতি।

বেবিচক ও বিমানের দুই কর্মকর্তা গতকাল বলেন, কার্গো হাউসটির মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে। এ ভবনে কাজ করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এ নিয়ে আজ (গতকাল) কয়েক দফা বৈঠক হয়েছে। ওষুধসহ অন্যান্য মালামালের বিষয়ে বিশদ আলোচনা হয়েছে। কিছু পণ্যের টেম্পারেচার কন্ট্রোল সেনসিটিভ, নির্দিষ্ট তাপমাত্রা সংরক্ষণ করতে হয়। আগুনে আমাদের তো ইমপোর্ট কমপ্লেক্স শেষ। এখন আমরা কাজ শুরু করেছি। কাল (আজ) থেকে আমরা টেম্পোরারি শেড বানাব। পাশাপাশি আমরা দুটি কুল রুমের ব্যবস্থা করছি। একটা দুই থেকে পাঁচ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার, অন্যটা ১৫ থেকে ২০ ডিগ্রির।

নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান, সপ্তাহের সাত দিন ২৪ ঘণ্টাই আমদানীকৃত পণ্য ডেলিভারি দেওয়া হবে। ইতোমধ্যে সার্কুলার জারি করা হয়েছে। ব্যাংক, কাস্টমস, বিমান ও বেবিচকের কর্তারা ছুটির দিনও অফিস করবেন। অবকাঠামোর সমস্যার কারণে আমরা দিশেহারা হয়ে পড়েছি। আমাদের এখন খুবই কষ্ট হচ্ছে। বাইরে রাখা মালামাল ত্রিপল দিয়ে ঢেকে রাখলেও নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা আছে। প্রতিদিন ৫শ টন মালামাল ডেলিভারি দেওয়া হয়।

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজের (বাপি) মহাসচিব ডা. মো. জাকির হোসেন বলেন, অগ্নিকাণ্ডে দেশের ওষুধশিল্পের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাঁচামাল ভস্মীভূত হয়ে গেছে। এই আকস্মিক ক্ষতি পুরো খাতকে বহুবিধ ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলেছে। বিকল্প হিসেবে অন্য এয়ারপোর্টে নামানো পণ্য নিয়েও উদ্বেগ আছে। কারণ এসব পণ্য নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় রাখতে হয়।

বিমানে সতর্কতা জারি : অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁঁকি রোধ ও কর্মক্ষেত্রে নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করতে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। প্রতিষ্ঠানের প্রকৌশল ও উপকরণ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের জারি করা নতুন এক সার্কুলারে বলা হয়েছে, অগ্নিনিরাপত্তা নিশ্চিত করা প্রত্যেক কর্মীর দায়িত্ব। নিয়ম না মানলে তা দায়িত্বে অবহেলা হিসেবে গণ্য হবে এবং শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কর্মস্থলে রান্না বা গরম করার যন্ত্রপাতি ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ইলেকট্রিক কেটলি, রাইস কুকার, স্টোভ বা এ ধরনের যন্ত্র কোনো অফিস বা ওয়ার্কশপে রাখা যাবে না। ইতোমধ্যে যেসব স্থানে এসব যন্ত্র রয়েছে, তা অবিলম্বে সরিয়ে ফেলতে হবে। এ ছাড়া ধূমপান নীতিমালা আরও কঠোরভাবে বাস্তবায়নের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কর্মস্থলে ধূমপান করা যাবে না। শুধু অফিশিয়ালি নির্ধারিত জোনেই ধূমপানের অনুমতি থাকবে। দাহ্য তরল পদার্থ ও রাসায়নিক দ্রবণ সংরক্ষণ বা ব্যবহারেও আরোপ করা হয়েছে কঠোর নিয়ন্ত্রণ। অনুমোদন ছাড়া এসব পদার্থ মজুদ রাখা যাবে না, আর প্রয়োজন হলে তা নির্ধারিত নিরাপত্তা নীতিমালা অনুযায়ী সংরক্ষণ করতে হবে। বৈদ্যুতিক নিরাপত্তার বিষয়েও কর্মীদের সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়, কোনো ক্ষতিগ্রস্ত বৈদ্যুতিক তার, সকেট, সুইচ বা বাতির ত্রুটি দেখলে সঙ্গে সঙ্গে তা সংশ্লিষ্ট শাখা প্রধানকে জানাতে হবে।