একের পর এক কারখানা বন্ধ, কর্মহীন ৬০ হাজার শ্রমিক

রায়হান উদ্দিন, চট্টগ্রাম
২১ অক্টোবর ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
একের পর এক কারখানা বন্ধ, কর্মহীন ৬০ হাজার শ্রমিক

শ্রমিক অসন্তোষ, সংঘর্ষ ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় দিশাহারা হয়ে পড়েছে চট্টগ্রাম রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের (সিইপিজেড) শিল্পপরিবেশ। ধারাবাহিকভাবে কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বেকার শ্রমিকের সংখ্যা বাড়ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত এক বছরে চট্টগ্রামে অর্ধশতাধিক ছোট-বড় পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। চাকরি হারিয়েছেন অন্তত ৬০ হাজার শ্রমিক। এর মধ্যে চলতি অক্টোবর মাসেই বেকার হয়েছেন প্রায় ৪০ হাজার শ্রমিক।

গত ১৭ অক্টোবর শ্রমিক অসন্তোষের জেরে দেশের বৃহত্তম তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান প্যাসিফিক জিন্স গ্রুপের আটটি কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এসব কারখানায় কাজ করা ৩৫ হাজার শ্রমিক এখন বেকার। এর ঠিক এক দিন আগে সিইপিজেডের অ্যাডামস ক্যাপস ও জিহং মেডিক্যাল প্রোডাক্টসের আটতলা ভবনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে। ১৭ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে আগুন জ্বলতে থাকে। এতে হাজার কোটি টাকার সম্পদ পুড়ে যায় এবং প্রায় ৩ হাজার শ্রমিকের কর্মসংস্থান অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।

চট্টগ্রাম শিল্প পুলিশ-৩ এর তথ্যমতে, চট্টগ্রাম অঞ্চলে বিজিএমইএ, বিকেএমইএ ও বিটিএমই এর আওতাধীন মোট পোশাক কারখানার সংখ্যা ৫৮০টি। এর মধ্যে বর্তমানে চালু রয়েছে ৫২৮টি। কার্যাদেশ না থাকায় গত এক বছরে অর্ধশতাধিক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। কারখানা সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, অর্ডার না থাকা, অর্থের অভাব, ব্যাংক ঋণের জটিলতা এবং শ্রমিক অসন্তোষসহ নানা কারণে তাদের উৎপাদন কার্যক্রম চালু রাখা সম্ভব হচ্ছে না।

এমন পরিস্থতি পোশাকশিল্পে অস্থিরতার নতুন ইঙ্গিত বলে মনে করছেন শিল্প বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, বহু বছর ধরে সফলভাবে রপ্তানি করা প্যাসিফিক জিনসের মতো গ্রুপে বারবার অস্থিরতা দেখা দিলে তা দেশের সামগ্রিক পোশাকশিল্পের ওপর আঘাত আসতে পারে। নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে রপ্তানি আয়ের ওপর।

বিজিএমইএর সাবেক প্রথম সহসভাপতি নাসির উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী বলেন, কার্যাদেশ কমে যাওয়ার পাশাপাশি রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ব্যাংকিং জটিলতার কারণেও অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। আমার নিজস্ব দুটি কারখানাও বন্ধ রাখতে হয়েছে। বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদন খরচ মারাত্মকভাবে বেড়েছে। ট্রেড ইউনিয়ন সক্রিয় থাকায় শ্রমিকরা অনেক সময় যৌক্তিক আবার কখনো অযৌক্তিক আন্দোলন করছে। আবার রাজনৈতিক নেতারা এসব আন্দোলনে ইন্ধন দিচ্ছেন। তিনি বলেন, সরকারের কাছ থেকেও আমরা প্রত্যাশিত সহযোগিতা পাচ্ছি না। বিজিএমইএ নেতাদের সঙ্গে সরকারের একাধিক বৈঠক হলেও বাস্তবে কোনো সুফল মেলেনি। বিনিয়োগ কমে গেছে, ব্যাংকগুলো ঋণ দিতে অনাগ্রহী। দিলেও নানা শর্ত আরোপ করছে। তার ওপর বিভিন্ন দলের নেতারা এসে চাঁদা দাবি করছেন। লোকসান দিয়ে কারখানা চালানোই কঠিন, তার ওপর আবার চাঁদা- এভাবে শিল্প টিকিয়ে রাখা অসম্ভব।

প্যাসিফিকের ৮ কারখানা বন্ধে রাজনৈতিক ইন্ধন : বাংলাদেশ থেকে জিন্সের মোট রপ্তানি মূল্যের প্রায় ১৫ শতাংশ আসে প্যাসিফিক জিন্স থেকে। এই গ্রুপের মোট সম্পদের পরিমাণ প্রায় ১০০ কোটি ডলার বা ১০ হাজার কোটি টাকা। তাদের কোনো ব্যাংকঋণ নেই; মুনাফা থেকেই তারা ব্যবসা সম্প্রসারণ করেছে। এই শিল্প গ্রুপকে রাতারাতি বন্ধ করে দেওয়ায় ৩৫ হাজার শ্রমিক বেকার। বন্ধের পেছনে রাজনৈতিক ইন্ধন দেখছেন তারা।

এনামুল হক নাবিদ নামে এক শ্রমিক বলেন, কারখানার সব শ্রমিক সংঘাত-সংঘর্ষে জড়ায়নি। যারা জড়িয়েছে তারা সংখ্যাই বেশি নয়। তারা দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গেও জড়িত। কারাখানা কর্তৃপক্ষ তাদের বিরুদ্ধে কেন আইনি ব্যবস্থা নিচ্ছে না। প্রয়োজনে তাদের চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হোক। তাদের কারণে কারখানাগুলোর হাজার হাজার নিরপরাধ শ্রমিক কেন কষ্ট পাবে।

চট্টগ্রাম শিল্প পুলিশের পুলিশ সুপার আবদুল্লাহ আল মাহমুদ বলেন, প্যাসিফিক জিনসে শ্রমিকদের মধ্যে কিছু অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব আছে। দ্বন্দ্ব থেকে বৃহস্পতিবার ফের সংঘাত-সংঘর্ষ, মারামারি। রাষ্ট্রকে অস্থিতিশীল করার লক্ষ্যে বাইরে থেকে ইন্ধন আসতে পারে। বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।