বাস্তবায়ন চ্যালেঞ্জে দুর্বল ব্যাংক শনাক্ত নীতিমালা

উচ্চ খেলাপি ঋণ ও মূলধন ঘাটতি

জিয়াদুল ইসলাম
১৯ অক্টোবর ২০২৫, ০৭:৩৮
শেয়ার :
বাস্তবায়ন চ্যালেঞ্জে দুর্বল ব্যাংক শনাক্ত নীতিমালা

ব্যাংকিং খাতে অস্থিতিশীলতা রোধ ও আর্থিক শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ‘প্রম্পট কারেক্টিভ অ্যাকশন’ (পিসিএ) ফ্রেমওয়ার্ক নামে একটি নীতিমালা জারি করেছে। এটি চলতি বছরের মার্চ থেকে বাস্তবায়নের কথা ছিল। আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে প্রণীত এই কাঠামো দুর্বল ব্যাংক শনাক্ত করে আগাম পদক্ষেপ নেওয়ার একটি শক্তিশালী ব্যবস্থা। তবে খেলাপি ঋণের লাগামহীন বৃদ্ধি ও মূলধন ঘাটতি এটি বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংক পিসিএ ফ্রেমওয়ার্কের বাস্তবায়নযোগ্যতা পুনর্মূল্যায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনে করছে, এখনই পিসিএ প্রয়োগ করলে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ব্যাংক বিভিন্ন বিধিনিষেধের আওতায় পড়বে। এতে ব্যাংক খাতের স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধার আরও কঠিন হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. আরিফ হোসেন খান বলেন, একটি স্থিতিশীল ও টেকসই ব্যাংকিং ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে আমরা সব সময় বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনায় নীতিমালা প্রণয়ন ও প্রয়োগ করি। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে ব্যাংকগুলোর আর্থিক সক্ষমতা ও ঝুঁকি পরিস্থিতি আরও গভীরভাবে মূল্যায়নের স্বার্থে পিসিএ পুনর্মূল্যায়নের সিদ্ধান্ত হয়েছে।

পিসিএ ফ্রেমওয়ার্ক অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল ব্যাংক শনাক্ত করে। এর মাধ্যমে ব্যাংকের কার্যক্রমে নিয়ন্ত্রণ আরোপ এবং উত্তরণের পদক্ষেপ নেওয়া হয়। আইএমএফের ঋণের শর্ত বাস্তবায়নে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে নীতিমালাটি জারি করা হয়েছিল। নীতিমালায় পাঁচটি সূচকের ভিত্তিতে ব্যাংকগুলোর ক্যাটাগরি নির্ধারণ করা হবে। সেসব সূচকের মধ্যে আছে মূলধন পর্যাপ্ততার অনুপাত, প্রকৃত খেলাপি ঋণ এবং করপোরেট গভর্ন্যান্স। যেসব ব্যাংকের প্রকৃত খেলাপি ঋণ ৫ শতাংশের বেশি এবং মূলধন সংরক্ষণের অনুপাত ১২.৫ শতাংশের কম, সেগুলো চারটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হবে।

ক্যাটাগরি অনুযায়ী কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যাংকের পরিচালন খরচ বৃদ্ধি, লভ্যাংশ বিতরণ, নতুন শাখা খোলা, আমানত ও ঋণ বিতরণ বন্ধ এবং একীভূত করার সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। ২০২৪ সালের নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদনের ভিত্তিতে এটি ২০২৫ সালের মার্চ থেকে কার্যকর করার কথা ছিল। তবে গত ১ জুলাই থেকে খেলাপি ঋণের নতুন সংজ্ঞা কার্যকর হয়েছে। এতে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বিগত সরকারের সময়ে লুকিয়ে রাখা খেলাপি ঋণের চিত্র বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। ফলে ব্যাংক খাতে অস্বাভাবিকভাবে খেলাপি ঋণ বেড়েছে। এতে মূলধন ঘাটতির চিত্রও ক্রমশ খারাপ হচ্ছে।

এই পরিস্থিতিতে পিসিএ প্রয়োগ করলে ব্যাংক খাতের স্থিতিশীলতায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। এ নিয়ে গত জুলাই মাসে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক স্থিতিশীলতা কমিটির প্রথম সভায় ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ-২ থেকে একটি এজেন্ডা উপস্থাপন করা হয়। ওই সভায় বলা হয়, খেলাপি ঋণের নতুন সংজ্ঞা ও মূলধন ঘাটতি পিসিএ বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে গভর্নর আহসান এইচ মনসুর পিসিএ ফ্রেমওয়ার্কের আইনগত ও কার্যকর বাস্তবায়নযোগ্যতা পুনর্মূল্যায়নের নির্দেশ দেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, ‘অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা কমিটির সিদ্ধান্তের পর আমরা সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো মিলে বৈঠক করেছি। পিসিএ প্রয়োগ ইস্যুতে সমন্বয় করে কাজ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। কারণ, এরই মধ্যে দুর্বল পাঁচটি ব্যাংক একীভূত করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। পিসিএ ফ্রেমওয়ার্ক ২০২৪ সালের চূড়ান্ত আর্থিক প্রতিবেদনের ভিত্তিতে প্রয়োগের কথা। তবে আমরা এখনও সব ব্যাংকের চূড়ান্ত প্রতিবেদন পাইনি। চতুর্থ প্রজন্মের ইউনিয়ন ব্যাংকের প্রতিবেদন এখনও বাকি। এ ছাড়া রাকাব ও বিকেবির রিপোর্টিংয়ের সময়সীমা ভিন্ন। তাদেরও চূড়ান্ত প্রতিবেদন আমরা পাইনি।’

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজম্যান্টের (বিআইবিএম) সাবেক মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমেদ চৌধুরী বলেন, পটপরিবর্তনের পর ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের চিত্র ভয়াবহ। মূলধন পর্যাপ্ততায় অনেক ব্যাংক পিছিয়ে রয়েছে। পিসিএ বাস্তবায়ন কঠিন হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পুনর্মূল্যায়ন সিদ্ধান্ত বাস্তব পরিস্থিতির স্বীকৃতি। কিন্তু দুর্বল ব্যাংকগুলোর প্রতি নীতিগত ছাড় হওয়া উচিত নয়। যেগুলো চলতে পারছে না, তাদের বিষয়ে যথাযথ সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এসেছে।

খেলাপি ঋণের নতুন সংজ্ঞা অনুযায়ী, ঋণ বা কিস্তি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পরিশোধ না হলে পরের দিন থেকেই মেয়াদোত্তীর্ণ হবে। ঋণ তিন মাস মেয়াদোত্তীর্ণ থাকার পর পরিশোধিত বা নবায়ন না হলে খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হবে। আগে কিছু ঋণ ছয় মাস পর খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হতো। ফলে নতুন সংজ্ঞায় ঋণখেলাপি হওয়ার সময় তিন মাস কমেছে।

আওয়ামী লীগ সরকারের সময় কিছু গ্রুপ ঋণ নামে অর্থ বের করেছে। তাদের বড় অঙ্কের ঋণ দিতে নানা সুবিধা দেওয়া হয়েছিল। খেলাপি ঋণ কাগজে-কলমে কম দেখাতে নেওয়া হয়েছিল একের পর এক নীতি। সরকার পরিবর্তনের পর সেই নীতি থেকে সরে আসে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে খেলাপি ঋণ কম দেখানোর সুযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে এখন খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র বেরিয়ে আসছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, মার্চ পর্যন্ত ব্যাংক খাতে মোট বিতরণকৃত ঋণ ১৭ লাখ ৪১ হাজার ৯৯২ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৪ লাখ ২০ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা খেলাপি, যা মোট ঋণের ২৪.১৩ শতাংশ। গত বছরের ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা বা ২০.২০ শতাংশ। ফলে জানুয়ারি-মার্চ তিন মাসে ঋণ বেড়েছে ৭৪ হাজার ৫৬৯ কোটি টাকা। গত বছরের সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি বা ১৬.৯৩ শতাংশ। ছয় মাসে ঋণ বেড়েছে প্রায় ১ লাখ ৩৫ হাজার ৩৫৬ কোটি টাকা। গত বছরের মার্চে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি বা ১১.১১ শতাংশ। এক বছরের ব্যবধানে ঋণ বেড়েছে ২ লাখ ৩৮ হাজার কোটি টাকা।

২০২৪ সালের ডিসেম্বর শেষে সরকারি-বেসরকারি ১৯টি ব্যাংকের মোট মূলধন ঘাটতি ছিল ১ লাখ ৭১ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। এটি সর্বোচ্চ রেকর্ড। এ সময়ে ব্যাংক খাতে মূলধন ঝুঁকিজনিত সম্পদের অনুপাত (সিআরএআর) নেমে এসেছে মাত্র ৩.০৮ শতাংশ, যা আন্তর্জাতিক কাঠামো ব্যাসেল-৩ অনুযায়ী ন্যূনতম ১০ শতাংশ থাকা উচিত। তিন মাস আগে সিআরএআর ছিল ৬.৮৬ শতাংশ। ২০২৪ সালের জুনে সিআরএআর ছিল ১০.৬৪ শতাংশ।