সংকটেও ব্যাংক আমানতে চমক

জিয়াদুল ইসলাম
১৭ অক্টোবর ২০২৫, ০০:৪৬
শেয়ার :
সংকটেও ব্যাংক আমানতে চমক

ব্যাংক খাতে আমানত পরিস্থিতির আরও উন্নতি হয়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট) আমানত বেড়েছে প্রায় ২৮ হাজার কোটি টাকা। এতে আগস্ট শেষে বার্ষিক আমানতের প্রবৃদ্ধি ফের ২ অঙ্কের ঘরে উঠেছে, যা গত দেড় বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। মূলত এ সময়ে মানুষের হাতে থাকা নগদ অর্থের প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা ব্যাংকে ফেরত আসায় আমানতে প্রবৃদ্ধিতে এই উল্লম্ফন হয়েছে। খাত সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, সুশাসন প্রতিষ্ঠা, সুদের হার বৃদ্ধি এবং বেসরকারি বিনিয়োগ মন্দার কারণে ব্যাংকগুলোতে আমানত বাড়ছে। এখন সরকারি ব্যাংকের পাশাপাশি আর্থিক ভিত শক্তিশালী এমন বেসরকারি ব্যাংকেও আমানতে ভালো প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। তবে যেসব ব্যাংক দুর্বল, তারা নতুন আমানত টানতে পারছে না, উল্টো আমানত হারাচ্ছে।

পতিত শেখ হাসিনা সরকারের আমলে ব্যাংক খাতে নানা অনিয়ম ও লুটপাটের কারণে গ্রাহকের মধ্যে আস্থা সংকট বিরাজ করছিল। নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর তা সামনে আসায় বেশ কয়েকটি ব্যাংকের প্রতি আস্থার সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছিল। ফলে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে হাতে রাখার প্রবণতা দেখা দেয়। তবে সুদের হার বৃদ্ধিসহ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংস্কারমূলক নানা পদক্ষেপে আস্থার সংকট কাটতে শুরু করেছে। ফলে ঘরের টাকা আবার ব্যাংকে ফিরছে। এ ছাড়া রাজনৈতিক অস্থিরতায় বিনিয়োগে ঝুঁকি না নিয়ে ব্যাংকে টাকা রাখাকে নিরাপদ মনে করছেন অনেকে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, আমানত প্রবৃদ্ধির এই ধারা অর্থনীতিতে একটি ইতিবাচক সংকেত দিচ্ছে। এটি প্রমাণ করে, মানুষ ব্যাংকের প্রতি আগের মতোই নির্ভর করতে চাচ্ছে। তবে এই প্রবণতা টেকসই করতে ব্যাংক খাতে সুশাসন ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা জরুরি।

বাড়ছে আমানত, প্রবৃদ্ধি ২ অঙ্কের ঘরে : গত অর্থবছরের জুন শেষে ব্যাংক খাতে আমানতের পরিমাণ ছিল প্রায় ১৮ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। সেটি আগস্ট শেষে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৯ লাখ ৯৬ হাজার ৫৮৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ, মাত্র দুই মাসের ব্যবধানে (জুলাই-আগস্ট) ব্যাংক খাতে আমানত বেড়েছে ২৭ হাজার ৭৪০ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে গত আগস্ট শেষে ব্যাংক খাতে আমানত বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৯ লাখ ৪ হাজার ৭৪০ কোটি টাকা। এক বছর আগে ২০২৪ সালের আগস্টে ব্যাংক খাতে আমানতের পরিমাণ ছিল ১৭ লাখ ৩১ লাখ ২৬০ কোটি টাকা। ফলে এক বছরের ব্যাবধানে আমানত বেড়েছে প্রায় ১ লাখ ৭৩ হাজার ৪৮০ কোটি টাকা। বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার ১০ দশমিক ০২ শতাংশ। আগের মাস জুলাইতে আমানতের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ছিল ৮ দশমিক ৪২ শতাংশ। আর জুনে প্রবৃদ্ধি নেমেছিল মাত্র ৭ দশমিক ৭৭ শতাংশে। এর আগে ২ অঙ্কের ঘরে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। ওই মাসে বার্ষিক প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১০ দশমিক ৪৩ শতাংশ। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর তা আরও নিম্নমুখী হয়ে পড়েছিল। কারণ, ছাত্রদের কোটা সংস্কার আন্দোলন, গণ-অভ্যুত্থান এবং নতুন সরকার গঠনের পর একের পর এক ব্যাংকের পর্ষদ পুনর্গঠনের কারণে গত অর্থবছরের জুলাই থেকে আগস্ট এই দুই মাসে ব্যাংকগুলোতে আমানত কমেছিল প্রায় ১০ হাজার ৯০৭ কোটি টাকা।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে অনেকেই ব্যাংক থেকে টাকা তুলে হাতে রেখেছিলেন। এ ছাড়া কিছু ব্যাংকের পর্ষদ পুনর্গঠনের প্রভাবও পড়েছিল। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের নানা উদ্যোগে আস্থা ফিরতে শুরু করেছে। সুদের হার বাড়ায় নতুন আমানতও আসছে। যদিও তা খুব বেশি নয়, কারণ উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও বেকারত্ব বাড়ায় মানুষের সঞ্চয়ের সক্ষমতা কমেছে।

ব্যাংকের বাইরে নগদ অর্থ কমেছে : আস্থা সংকট কাটতে শুরু করায় ব্যাংকের বাইরে নগদ অর্থের পরিমাণ কমছে। গত অর্থবছরের জুন শেষে ব্যাংকের বাইরে নগদ অর্থের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৯৬ হাজার ৪৫১ কোটি টাকা। সেটি কমে চলতি অর্থবছরের আগস্ট শেষে দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৮৭ হাজার ২৯৪ কোটি টাকা। ফলে আলোচ্য দুই মাসে ব্যাংকের বাইরে নগদ অর্থ কমেছে প্রায় ১৯ হাজার ৯৫৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ, এর পরিমাণ টাকা গত দুই মাসে ব্যাংকে ফিরে এসেছে, যা আমানতের প্রবৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা রেখেছে। এর আগে গত মে ও জুন মাসে ব্যাংকের বাইরে নগদ অর্থের পরিমাণ বেড়েছিল প্রায় ১৯ হাজার ৮৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে কোরবানির ঈদের কারণে মে মাসে ১৬ হাজার ৪১২ কোটি টাকা ও জুন মাসে ২ হাজার ৬৭৩ কোটি টাকা বাড়ে। এ ছাড়া রোজার ঈদের কারণে গত মার্চ মাসে ব্যাংকের বাইরে নগদ অর্থ বেড়েছিল প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা। তবে এপ্রিলে মাসে আবার ব্যাংকের বাইরে নগদ অর্থ কমেছিল প্রায় ১৯ হাজার ৬৫ কোটি টাকা।

বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি আরও নিম্নমুখী : গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে প্রতি মাসেই বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি কমছে। গত বছরের জুলাইয়ে বেসরকারি খাতের ঋণে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১০ দশমিক ১৩ শতাংশ। সেটি কমতে কমতে গত জুনে নেমে আসে ৬ দশমিক ৪৫ শতাংশে। তবে চলতি অর্থবছরের জুলাই মাসে এই প্রবৃদ্ধি সামান্য বেড়ে হয় ৬ দশমিক ৫২ শতাংশ। তবে গত আগস্টে আবার নিম্নমুুখী হয়ে পড়েছে। ওই মাসে বার্ষিক আমানতের প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ৬ দশমিক ৩৫ শতাংশে, যা গত ২২ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।

আমাদের সময়/ এইচও