শিক্ষা ব্যবস্থাপনার মূলে সৃষ্ট গভীর ক্ষত উন্মোচিত
উচ্চ মাধ্যমিক সার্টিফিকেট (এইচএসসি) ও সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশ হয়েছে গতকাল বৃহস্পতিবার। দুই দশকের মধ্যে এবারই পাসের হার সর্বনিম্ন স্তরে নেমে এসেছে, যা শিক্ষাবিদ ও নীতিনির্ধারকদের মধ্যে ভীষণ উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। কিন্তু এটিই বাস্তবতা। এ ফল দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাপনার মূলে বছরের পর বছর ধরে সৃষ্ট গভীর এক ক্ষত উন্মোচন করেছে।
গত ১৬ বছরেরও বেশি সময় উন্নতির জমকালো মোড়কে সুসজ্জিত করে রাখা হয়েছিল শিক্ষাব্যবস্থাকে। এবারের ফল সেই মোড়কের আড়ালের বাস্তবতাই তুলে ধরেছে। এ ফলাফল এক নির্মম সত্যের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, এটি কষ্টের হলেও একই সঙ্গে নতুন জাগরণের সূচনাও করতে পারে। এ পতন হতে পারে শিক্ষায় পুনর্জাগরণের প্রথম আলোকরেখা।
ভয়াবহ পতনের পরিসংখ্যান
২০০৫ সালের পর এবারই প্রথম পাসের হার ৬০ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। ২০০৫ সালে পাসের হার ছিল ৫৯.১৬ শতাংশ, আর এবার তা নেমেছে ৫৮.৮৩ শতাংশে। গত বছরের (৭৭.৭৮) তুলনায় প্রায় ১৯ শতাংশ কমে গেছে সামগ্রিক পাসের হার। এবার মোট ১২ লাখ ৩৫ হাজার ৬৬১ শিক্ষার্থীর মধ্যে পাস করেছে ৭ লাখ ২৬ হাজার ৯৬০ জন। ফেল করেছে ৫ লাখ ৮ হাজার ৭০১ জন।
জিপিএ-৫ প্রাপ্তির সংখ্যাও অর্ধেকে নেমে এসেছে
গত বছর ১ লাখ ৪৫ হাজার ৯১১ জন জিপিএ-৫ পেলেও এবার সংখ্যা মাত্র ৬৯ হাজার ৯৭ জন।
ঢাকা এগিয়ে, তলানিতে কুমিল্লা
৯টি সাধারণ বোর্ডের মধ্যে ঢাকা বোর্ডে সর্বোচ্চ পাসের হার ৬৪.৬২ শতাংশ, আর সবচেয়ে নিচে কুমিল্লা, মাত্র ৪৮.৮৬ শতাংশ। রাজশাহী ৫৯.৪০, যশোর ৫০.২০, চট্টগ্রাম ৫২.৫৭, বরিশাল ৬২.৫৭, সিলেট ৫১.৮৬, দিনাজপুর ৫৭.৪৯ এবং ময়মনসিংহ বোর্ডে ৫১.৫৪ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করেছে।
ঢাকা মহানগরে ৮৪.০৩ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করেছে, তবে একই বোর্ডের অধীনেই সাতটি জেলায় পাসের হার ৫০ শতাংশের নিচে। সর্বনিম্ন গোপালগঞ্জে (৪২.২৮ শতাংশ)। এ জেলায় সংঘর্ষের পর কারফিউর কারণে পরীক্ষায় বিলম্ব ঘটেছিল।
ইংরেজি ও আইসিটিতে বিপর্যয়
ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ইংরেজি এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি)- এ দুটি বিষয়ে এবার সবচেয়ে বড় বিপর্যয় ঘটেছে। বেশিরভাগ বোর্ডেই ইংরেজিতে পাসের হার ৬০ শতাংশের নিচে। বরিশালে ইংরেজিতে সর্বোচ্চ পাস ৭৫.১৬ শতাংশ, এরপর ঢাকা বোর্ডে ৭৩.৬৬ শতাংশ। যশোর বোর্ডে সর্বনিম্ন ৫৪.৮২ শতাংশ।
ঢাকা বোর্ড চেয়ারম্যান অধ্যাপক খন্দকার এহসানুল কবির বলেন, যশোরে ইংরেজিতে ফেল করেছে ৪৫ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী। অন্য বোর্ডেও একই প্রবণতা দেখা গেছে, ফলে সামগ্রিক ফল অনেক নিচে নেমেছে।
মানবিকে বিপর্যয়
মানবিক বিভাগে ফেল ৫১.৫৫ শতাংশ অর্থাৎ প্রতি দুই শিক্ষার্থীর একজন অকৃতকার্য। ছেলেদের মধ্যে ফেল ৫৭ শতাংশ, মেয়েদের মধ্যে ৪৬ শতাংশ।
মানবিক বিভাগে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৩১ হাজার ৯৪৯, পাস করেছে ৬৫ হাজার ২৫০ জন।
অন্যদিকে, বিজ্ঞান বিভাগে পাসের হার ৮৫.৮৩ শতাংশ, ব্যবসায় শিক্ষায় ৬৪.৬৯ শতাংশ। দুই ক্ষেত্রেই মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে এগিয়ে। মোট জিপিএ-৫ পাওয়া ৬৯ হাজার ৯৭ জনের মধ্যে মেয়ে ৩৭ হাজার ৪৪ জন, ছেলে ৩২ হাজার ৫৩ জন।
প্রতিষ্ঠানভিত্তিক চিত্র
আরও পড়ুন:
একে আবদুল মোমেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী
এ বছর মাত্র ৩৪৫টি প্রতিষ্ঠানের শতভাগ শিক্ষার্থী পাস করেছে। গত বছর ছিল ১ হাজার ৩৮৮টি প্রতিষ্ঠান। অর্থাৎ, এক বছরে শতভাগ পাস প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কমেছে ১ হাজারেরও বেশি। বিপরীতে, শূন্য (০%) পাস করা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ২০২, গত বছর ছিল ৬৫টি।
দেশের বাইরে আটটি কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত পরীক্ষায় পাসের হার ৯৫.৮৮ শতাংশ।
ফিরে দেখা ফলাফলের ধারাবাহিকতা
ব্যানবেইসের তথ্য বলছে, ২০০৮ সালে পাসের হার একসময় ৭৫ শতাংশ ছাড়ালেও পরে তা ৭০-৮০ শতাংশে ওঠানামা করেছে। করোনা-পরবর্তী বছরগুলোয় সংক্ষিপ্ত সিলেবাস ও সহজ মূল্যায়নের কারণে ফলাফল ছিল অস্বাভাবিকভাবে ভালো। ২০২০ সালে অটোপাসে শতভাগ, ২০২১ সালে ৯৫ শতাংশ, ২০২২ সালে ৮৬ শতাংশ আর ২০২৩ সালে পাস ছিল ৭৮ শতাংশ।
এ বছর পূর্ণ সিলেবাস ও পূর্ণ নম্বরের পরীক্ষায় বাস্তব ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে বলে কর্তৃপক্ষের দাবি।
এটাই বাস্তব ফল
ঢাকা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক খন্দকার এহসানুল কবির বলেন, আমরা কোনো পরীক্ষককে অতিরিক্ত নম্বর দিতে বলিনি। উত্তরপত্র মূল্যায়নের নিয়ম মেনে, নিরপেক্ষভাবে খাতা দেখা হয়েছে। তাই এটাই রিয়েল (বাস্তব) ফলাফল। তিনি অবশ্য স্বীকার করেন, এত শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হওয়া কাম্য নয়, কিন্তু শিক্ষার মান যখন তলানিতে পৌঁছে গিয়েছিল, তখন কোথাও না কোথাও থামতে হতোই।
শিক্ষা উপদেষ্টা ও শিক্ষাবিদরা যা বলছেন
শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. চৌধুরী রফিকুল আবরার গতকালের সংবাদ সম্মেলনে বলেন, এতদিন ভালো ফলাফল দেখাতে গিয়ে শিক্ষার প্রকৃত সংকট আড়াল করা হয়েছিল। তিনি বলেন, প্রাথমিক স্তর থেকেই ঘাটতি তৈরি হয়ে বছর বছর তা সঞ্চিত হয়েছে; এখন সেই দায় ফিরে এসেছে পুরো ব্যবস্থার ওপর। এটি হয়তো কষ্টের, কিন্তু এটি সত্যের দিকে ফেরার সূচনা। এ ফলাফল আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে। আমরা তিনটি নীতিতে এগোতে চাইÑ এক. বাস্তবতা থেকে মুখ ফিরিয়ে নয়, বাস্তবতাকে বুঝে এগোনো; দুই. দোষারোপ নয়, সমাধান খোঁজা এবং তিন. সংখ্যা নয়, শেখার মানকে সাফল্যের মাপকাঠি করা।
শিক্ষা উপদেষ্টা বলেন, এইচএসসির ফলাফল তাই কেবল একটি পরীক্ষার পরিসংখ্যান নয়, বরং একটি জাতির আত্ম সমালোচনার আয়না। দুই দশক ধরে জমে থাকা অক্ষমতা, মুখস্থ নির্ভরতা ও ব্যবস্থাপনাগত দুর্বলতা এবার উন্মুক্ত হয়েছে বলে জানান উপদেষ্টা। তিনি বলেন, এটি বেদনাদায়ক কিন্তু প্রয়োজনীয়ও বটে। কারণ, পতনের এই প্রান্ত থেকেই হয়তো শুরু হবে শিক্ষার প্রকৃত পুনর্জাগরণ যেখানে সাফল্যের মুখোশ নয় বরং মেধা, পরিশ্রম ও সত্যিকার শেখার সংস্কৃতি হবে মূল ভিত্তি।
গণসাক্ষরতা অভিযানের প্রধান নির্বাহী রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, স্বাভাবিক পরীক্ষায় ফিরেছি, কিন্তু শিক্ষার্থীদের স্বাভাবিক প্রস্তুতি কোথায়? ক্লাসে পাঠদান ও অনুশীলনে ঘাটতি রয়ে গেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক সিদ্দিকুর রহমানের মতে, সিলেবাস বা পদ্ধতি বদলানোর অজুহাতে এ ব্যর্থতা ঢেকে রাখা যাবে না। এত শিক্ষার্থী ফেল করল। তারা কোথায় যাবে? তাদের ভবিষ্যৎ কি অন্ধকারে ফেলে দিচ্ছি?
অন্যদিকে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ মাজেদা বেগম বলেন, সরকার মেধার মূল্যায়নে জোর দিয়েছে। প্রশ্ন ও মূল্যায়নের ধারা পরিবর্তনের ফলে ফল খারাপ হলেও প্রকৃত যোগ্যতার প্রতিফলন ঘটেছে।