পুষ্টি শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা বাড়ানো জরুরি

সাক্ষাৎকার খালেদা ইসলাম

রণজিৎ সরকার
১৬ অক্টোবর ২০২৫, ০৮:৪৫
শেয়ার :
পুষ্টি শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা বাড়ানো জরুরি

অধ্যাপক ড. খালেদা ইসলাম। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের সদ্যবিদায়ী পরিচালক। আজ ১৬ অক্টোবর বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়ে পালিত হচ্ছে বিশ্ব খাদ্য দিবস। খাদ্যনিরাপত্তা, বৈশ্বিক খাদ্য সংকট, পুষ্টি, অপুষ্টি, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর খাদ্যে বৈষম্য,

মানুষের খাদ্যাভ্যাসসহ প্রাসঙ্গিক বিষয়ে কথা বলেছেন আমাদের সময়ের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রণজিৎ সরকার

আমাদের সময় : পুষ্টির ঘাটতি এবং খাদ্যব্যবস্থার টেকসই উন্নয়নে আমাদের কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত বলে মনে করেন?

খালেদা ইসলাম : বাংলাদেশ পুষ্টির বিভিন্ন সূচকে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করলেও এখনও বিরাট জনগোষ্ঠী অপুষ্টিতে ভুগছে। বিশেষত শহরাঞ্চলে পুষ্টির মান ও সেবা সবই অত্যন্ত জটিল। একদিকে যেমন জনসংখ্যা বাড়ছে, অন্যদিকে মানুষের বিভিন্ন চাহিদাগুলোর প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। বিশেষত নিরাপদ খাদ্য, শিক্ষা, ওয়াশ ইত্যাদি নিশ্চিতকরণ পুষ্টির মান উন্নয়নে সবচেয়ে জরুরি। খাদ্যব্যবস্থাকে টেকসই করতে হলে শুধু উৎপাদন নয়, খাদ্যের মান, নিরাপত্তা ও প্রাপ্যতা সবকিছু নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য পুষ্টি সমবেদনশীল বিভিন্ন কার্যক্রম যেমন- কৃষি উৎপাদন, ফসল, প্রাণিসম্পদ ও মাছের সমন্বিত চাষ বাড়াতে হবে। খাদ্য সংরক্ষণ, অপচয় রোধ ও বাজারজাতকরণে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নারী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ বাড়াতে পারলে খাদ্যব্যবস্থা আরও স্থিতিশীল ও অন্তর্ভুক্তিমূলক হবে।

আমাদের সময় : বৈশ্বিক খাদ্য সংকটের ফলে সংঘাত, জলবায়ু পরিবর্তন, অসমতা এবং অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ বিভিন্ন কারণে খাদ্যনিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে আমাদের কতটুকু গুরুত্ব দেওয়া উচিত বলে মনে করেন?

খালেদা ইসলাম : বৈশ্বিক খাদ্য সংকট ও কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির গুরুত্ব বিশ্বজুড়ে সংঘাত, জলবায়ু পরিবর্তন ও মূল্যস্ফীতির প্রভাবে খাদ্যনিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়েছে। বিশেষত ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ কিংবা আঞ্চলিক সংঘাত যেমন মিয়ানমার সংকট এই মূল্যস্ফীতিতে ভূমিকা রাখছে। কিন্তু তার খারাপ প্রভাব পড়ছে সাধারণ জনগণের ওপর। বাংলাদেশে খাদ্যদ্রব্যের মূল্যস্ফীতির কারণে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ক্রয়ক্ষমতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এই পরিস্থিতিতে আমাদের কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি ও দক্ষতা বাড়ানো অপরিহার্য। জলবায়ু সহনশীলজাত, টেকসই সেচব্যবস্থা এবং কৃষি প্রণোদনা কর্মসূচি জোরদার করতে হবে। একই সঙ্গে খাদ্যের গুণগত মান ও নিরাপত্তা নিশ্চিত রাখাও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

আমাদের সময় : আমাদের লোকসংখ্যা এখনও বছরে প্রায় ২০ লাখ করে বাড়ছে; কৃষিজমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। ভবিষ্যতে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার ঝুঁকি আছে কিনা, যখন বিপুলসংখ্যক মানুষের খাদ্যপ্রাপ্তি অনিশ্চিত হয়ে উঠতে পারে?

খালেদা ইসলাম : প্রতিবছর প্রায় ২০ লাখ নতুন মুখ যোগ হচ্ছে, অথচ কৃষিজমি ক্রমেই কমছে- এটি ভবিষ্যতের খাদ্যনিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি। বর্তমানে বছরে প্রায় ১ শতাংশ হারে কৃষিজমি কমছে। তাই কৃষিজমি সংরক্ষণ আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে। নগর ও ছাদ কৃষি, হাইড্রোপনিক ও ভার্টিক্যাল ফার্মিংয়ের মতো আধুনিক পদ্ধতি গ্রহণ করা জরুরি। একই সঙ্গে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে শিক্ষা ও সচেতনতা বাড়ানোও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

আমাদের সময় : অপুষ্টিতে ভোগা লাখ লাখ মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাবের ফলে শারীরিক বৃদ্ধি ও উন্নয়নের ক্ষতি হয়। এ কারণে খাদ্যনিরাপত্তা এবং পুষ্টিকর খাবারের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে কী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে?

খালেদা ইসলাম : খাদ্যনিরাপত্তা শুধু পর্যাপ্ত খাদ্য নয়, পুষ্টিকর ও নিরাপদ খাদ্যের নিশ্চয়তা। এজন্য জাতীয় পুষ্টি কর্মপরিকল্পনা (ঘচঅঘ-২) অনুযায়ী বহুখাতীয় সমন্বয় জোরদার করতে হবে। মাতৃ ও শিশুপুষ্টি উন্নয়নে মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট সম্পূরকতা এবং স্কুল ফিডিং প্রোগ্রাম সম্প্রসারণ জরুরি। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত শাকসবজি, ফলমূল ও প্রোটিনসমৃদ্ধ খাদ্যকে উৎসাহ দিতে হবে। খাদ্য সংরক্ষণে প্রযুক্তির ব্যবহার ও খাদ্য অপচয় রোধও গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।

আমাদের সময় : দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পুষ্টিগত অবস্থা ভালো নয়। বিশেষ করে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর নারী ও শিশুদের অবস্থা খুবই শোচনীয়। তাদের জন্য সরকারের কোনো কার্যক্রমের উদ্যোগ আছে কিনা?

খালেদা ইসলাম : সরকার বর্তমানে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য ঠএউ, ঠএঋ, মাতৃত্বকালীন ভাতা ও স্কুল ফিডিং কর্মসূচি চালাচ্ছে। এসব উদ্যোগের ফলে শিশু খর্বতার হার গত এক দশকে ৩৩% থেকে ২৪%-এ নেমে এসেছে। তবে দরিদ্র নারী ও শিশুদের অবস্থা এখনও উদ্বেগজনক। তাদের জন্য আয়বর্ধক কার্যক্রম, পুষ্টি শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা আরও বাড়ানো জরুরি। দীর্ঘমেয়াদে নারীর ক্ষমতায়ন ও সচেতনতা বৃদ্ধিই স্থায়ী সমাধান এনে দিতে পারে।

আমাদের সময় : উচ্চশিক্ষার বিষয় হিসেবে খাদ্য ও পুষ্টিবিজ্ঞান আমাদের দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয়। বর্তমান ও আগামীর টেকসই জনস্বাস্থ্য নিশ্চিত করার লক্ষ্যে পুষ্টিবিষয়ক গবেষণা কি যথেষ্ট হচ্ছে?

খালেদা ইসলাম : দেশে পুষ্টিবিষয়ক গবেষণা হচ্ছে, তবে তা পর্যাপ্ত নয় এবং বেশির ভাগই একাডেমিক পর্যায়ে সীমিত। বর্তমানে শিশুদের মধ্যে প্রায় ২২% ওজনহীন এবং ১.৪% অতিরিক্ত ওজনের- এই দুই চরম অবস্থা নিয়ে আরও বাস্তবমুখী গবেষণা প্রয়োজন। বিশ্ববিদ্যালয়, ইঘঘঈ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বিত উদ্যোগ বাড়ানো দরকার। বিশেষ করে খাদ্যদূষণ, জলবায়ু পরিবর্তন ও খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তনজনিত পুষ্টি সমস্যায় গুরুত্ব দিতে হবে। গবেষণার ফলাফলকে নীতিনির্ধারণ ও কর্মপরিকল্পনায় প্রয়োগযোগ্য করা অপরিহার্য।

আমাদের সময় : মানুষের খাদ্যাভ্যাস ক্রমেই পরিবর্তিত হচ্ছে। আবার ধনী ও গরিবের ব্যবধান বেড়ে চলেছে। ফলে তারা পুষ্টিকর ও স্বাস্থ্যসম্মত খাবারের চাহিদা মেটাতে পারছে না। এটি নিরসনে পদক্ষেপ কী হওয়া উচিত?

খালেদা ইসলাম : মানুষের খাদ্যাভ্যাস দ্রুত বদলাচ্ছে; মাংস, প্রক্রিয়াজাত খাবার ও জাঙ্ক ফুডের দিকে ঝোঁক বাড়ছে। ধনী-গরিবের খাদ্য ব্যয়ে পার্থক্য পুষ্টি বৈষম্য বাড়াচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে জনগণের মধ্যে পুষ্টি শিক্ষা ও সচেতনতা বাড়াতে হবে। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য ভর্তুকিযুক্ত পুষ্টিকর খাদ্য সরবরাহ এবং স্থানীয় খাদ্য উৎসে বৈচিত্র্য আনতে হবে। পাশাপাশি জাঙ্ক ফুডের বিজ্ঞাপন ও বিক্রয় নিয়ন্ত্রণে কার্যকর নীতি প্রণয়ন করা উচিত।

আমাদের সময় : আমাদের মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যুর হার এখনও অনেক বেশি। এ অবস্থার উত্তরণের পথ কী?

খালেদা ইসলাম : বাংলাদেশে মাতৃমৃত্যুর হার প্রতি এক লাখে প্রায় ১৩৬ জন এবং শিশুমৃত্যুর হার প্রতি এক হাজারে ২০ জন। এ হার কমাতে মানসম্মত গর্ভকালীন, প্রসবকালীন ও পরবর্তী সেবা নিশ্চিত করা জরুরি। শিশুর মেধা বিকাশে এক্সক্লুসিভ ব্রেস্টফিডিং ছয় মাস অবধি বজায় রাখা অত্যন্ত প্রয়োজন। শিশুর ওজন নিয়ন্ত্রণ ও পুষ্টি পর্যবেক্ষণ নিয়মিত করা উচিত। স্কুলে স্বাস্থ্য ও পুষ্টি শিক্ষা চালু করলে শিশুদের মধ্যে সুষম খাদ্যাভ্যাস গড়ে উঠবে।

আমাদের সময় : আমাদের সব ধরনের খাদ্যে দূষিত ও ক্ষতিকর উপাদানের মাত্রা বিপজ্জনকভাবে বেড়ে গেছে। খাদ্যে ভেজাল ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। কৃষি উৎপাদন থেকে শুরু করে কৃষিপণ্য সংরক্ষণ, সরবরাহ ও বিপণন পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থের ব্যবহারের ফলে আমাদের সব খাদ্য দূষিত, অনিরাপদ ও ক্ষতিকর হয়ে পড়েছে। এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের উপায় কী?

খালেদা ইসলাম : দেশে খাদ্যে ভেজাল ভয়াবহ রূপ নিয়েছে, এর সমাধানে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের (ইঋঝঅ) সক্ষমতা আরও বাড়ানো প্রয়োজন। কৃষিপণ্য উৎপাদন থেকে বিপণন পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে মনিটরিং জোরদার করতে হবে। রাসায়নিক ব্যবহারে কঠোর নিয়ন্ত্রণ, ল্যাব টেস্টিং ও ট্রেসেবিলিটি ব্যবস্থা চালু করা জরুরি। জনসচেতনতা এবং গণমাধ্যমে প্রচারও এই লড়াইয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

আমাদের সময় : বাংলাদেশে খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে, কিন্তু নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত হওয়ার জায়গাটা দিন দিন আরও কঠিন হয়ে পড়ছে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, গত পাঁচ বছরে দেশে কীটনাশকের ব্যবহার বেড়েছে ৮১ দশমিক ৫ শতাংশ। ধান, শাকসবজি থেকে শুরু করে ফলমূল, এমনকি মাছ চাষেও ব্যাপক হারে ব্যবহার হচ্ছে কীটনাশক। কীটনাশক নিয়ন্ত্রণে কী ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে?

খালেদা ইসলাম : দেশে গত পাঁচ বছরে কীটনাশকের ব্যবহার বেড়েছে ৮১ শতাংশ, যা মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ভয়াবহ হুমকি। এ প্রবণতা রোধে ইন্টিগ্রেটেড পেস্ট ম্যানেজমেন্ট (ওচগ) ও জৈব কৃষি পদ্ধতি জনপ্রিয় করতে হবে। কীটনাশক বিক্রিতে কঠোর নিয়ন্ত্রণ, লেবেলিং ও নিয়মিত মনিটরিং বাধ্যতামূলক করা উচিত। কৃষকদের বিকল্প পদ্ধতি সম্পর্কে প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। নিয়মিত ল্যাব টেস্টিং ও তথ্য প্রকাশের মাধ্যমে জনআস্থা ফিরিয়ে আনা সম্ভব।

আমাদের সময় : ‘সুষম খাদ্যাভ্যাস’ গড়ে তুলতে আমাদের কী করা উচিত?

খালেদা ইসলাম : ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সুস্থতা নির্ভর করছে আজকের খাদ্যাভ্যাসের ওপর। এজন্য স্কুল পর্যায়ে পুষ্টি শিক্ষা ও স্কুল মিল প্রোগ্রাম চালু রাখা দরকার। পরিবারে পাঁচটি খাদ্যগ্রুপ- ধান্য, প্রোটিন, সবজি, ফল ও দুধের ভারসাম্য শেখানো জরুরি। জাঙ্ক ফুডের প্রচার নিয়ন্ত্রণ ও স্থানীয় পুষ্টিকর খাবারকে উৎসাহ দিতে হবে। কমিউনিটি পর্যায়ে বাগান, ফলমূল ও সবজি উৎপাদন কার্যক্রম শিশুদের হাতে-কলমে পুষ্টি শিক্ষা দেবে।

আমাদের সময় : সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

খালেদা ইসলাম : ধন্যবাদ।