জাবিতে ফের র‌্যাগিং

আলী হাসান মর্তুজা, জাবি
১৫ অক্টোবর ২০২৫, ০৭:৩৬
শেয়ার :
জাবিতে ফের র‌্যাগিং

জুলাই গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েও (জাবি) খুব একটা দৃশ্যমান ছিল না নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠিত র‌্যাগিং কালচার। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পূর্ণাঙ্গ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় খ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়টির নবীন শিক্ষার্থীরা প্রবেশের প্রথম দিনেই পাচ্ছেন আবাসিক হলের সিট। তবে ৫৪তম ব্যাচ আসার পর থেকে ফের শুরু হয়েছে র‌্যাগিং কালচার। গভীর রাতে বিভিন্ন আবাসিক হলের কক্ষে নবীন শিক্ষার্থীদের নিয়ে ম্যানার শেখানোর নামে করা হচ্ছে মানসিক নির্যাতন। জোরপূর্বক করানো হচ্ছে বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি। ফলে শারীরিকভাবেও আঘাতপ্রাপ্ত হচ্ছেন তাঁরা। ক্যাম্পাস চেনানোর নাম করে তাঁদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সিডনি ফিল্ড, সুইমিংপুলসহ বিভিন্ন নির্জন স্থানে নিয়ে র‌্যাগ দেওয়ার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে।

গত রবিবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ২১ নম্বর ছাত্র হলের ৪০৩নং কক্ষে প্রাণ রসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের নবীন শিক্ষার্থীদের তাঁদেরই বিভাগের সিনিয়র কর্তৃক র‌্যাগ দেওয়ার ঘটনা ঘটে। গোপন তথ্যের ভিত্তিতে দৈনিক আমাদের সময়ের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি প্রক্টর অধ্যাপক একেএম রাশিদুল আলম ও ২১ নম্বর হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক বোরহান উদ্দিনকে অবহিত করে ঘটনাস্থলে যান। এ সময় উক্ত হল সংসদের সাধারণ সম্পাদক ওয়ালি উল্লাহ আল-মাহদী, আ. ফ. ম. কামালউদ্দিন হল সংসদের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আবরার শাহরিয়ার এবং দুজন হল গার্ডসহ কয়েকজন শিক্ষার্থীও তাঁর সঙ্গে ছিলেন।

শুরুতেই দেখা যায় কক্ষটির বাইরে ৫৩তম ব্যাচের এক শিক্ষার্থী পাহারা দিচ্ছেন। এ সময় তিনি ভেতরে থাকা অন্যদের মুঠোফোনে খবর দেওয়ার চেষ্টা করলে তাঁকে বাধা দেওয়া হয়। কক্ষের ভেতরে প্রবেশ করে দেখা যায়, কক্ষটি সম্পূর্ণ অন্ধকার এবং দরজা-জানালা বন্ধ। সেখানে প্রাণ রসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের ৫৪তম ব্যাচের প্রায় ২০ শিক্ষার্থী ভীতসন্ত্রস্ত অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁদের সবার মোবাইল ফোন কেড়ে নিয়ে এক পাশে বন্ধ করে রাখা ছিল। প্রাথমিকভাবে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা ভয়ে কোনো কথা বলতে রাজি হননি। তবে পরবর্তীতে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক শিক্ষার্থী বলেন, আমাদের অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করা হয়েছে। কক্ষের বাতি নিভিয়ে জোরপূর্বক ফাইল হয়ে দাঁড় করিয়ে ভয়-ভীতি দেখানো হয়। এসব ঘটনা প্রকাশ করলে ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়। এ ঘটনায় বিভাগটির ৫৩ ব্যাচের ১৬ শিক্ষার্থীÑ মো. তানভীর রহমান মুন, মো. আব্দুল্লাহ আল ফাহাদ, আব্দুল্লাহ আল সাঈদ, মো. আবু তালহা রনি, রাজিব শেখ, এসএম মাহামুদুন্নবী, মো. আবু সাইদ, জান্নাতুল আদন, আহম্মেদ আরেফিন রাতুল, তাসনিমুল হাসান জুবায়ের, মো. মাহামুদুল হাসান ফুয়াদ, মো. আল হাসিব, মো. আব্দুল্লাহ আল নোমান, মো. রাকিবুল হাসান নিবির, মো. জাহিদুল ইসলাম এবং উশান্ত ত্রিপুরাকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে।

এদিকে অভিযুক্ত তানভীর রহমান মুন ও আব্দুল্লাহ আল সাইদ ছাত্রশিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত বলে দাবি তোলা হয় ক্যাম্পাস সংশ্লিষ্ট একটি ফেসবুক পেজ থেকে। তানভীরের ফেসবুক আইডিতে শেয়ার করা শিবিরের ইফতার মাহফিলের ছবিকে প্রমাণ হিসেবে পেশ করা হয়েছে। অন্যদিকে, আব্দুল্লাহ নিয়মিত জামায়াতের সমর্থনে বিভিন্ন পোস্ট ফেসবুকে শেয়ার করেছেন। এ নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে চলছে বিতর্ক। শিক্ষার্থীদের একাংশের দাবি, তাঁরা দুজন শিবিরকর্মী। অন্যদের দাবি, জাকসুতে থাকা শিবির নেতারাই দ্রুত বিচার নিশ্চিতে সহায়তা করেছেন। নিজেদের কর্মী হলে এমনটা করতেন না তাঁরা।

শাখা শিবির সেক্রেটারি মোস্তফিজুর রহমান বলেন, শিবিরের ইফতারে প্রায় ৩ হাজার শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করেছিলেন। তাঁদের যে কেউ ছবি তুলতেই পারেন। এর মাধ্যমে কাউকে শিবির বলা যায় না। অভিযুক্তরা শিবিরের কর্মী নন।

বিভিন্ন সংবাদপত্র সূত্রে জানা যায়, গত মাসে নবীন ব্যাচের ক্লাস শুরুর দিন দুপুরে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শ্রেণিকক্ষে নবীন শিক্ষার্থীদের র‌্যাগ দেন তাঁদেরই বিভাগের ১৫-২০ সিনিয়র শিক্ষার্থী। সিনিয়দের হুমকির কারণে বিষয়টি প্রকাশে ভয় পান ভুক্তভোগীরা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিভাগটির এক শিক্ষার্থী বলেন, সেদিন তাঁদের অকারণে ধমক, গালিগালাজ ও তিরস্কার করেন সিনিয়ররা। ঘটনার সময় কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন দুজন নারী শিক্ষার্থী। নবীন ব্যাচের প্রথম দিনের র‌্যাগিংয়ের ঘটনায় ছাত্রলীগের জাহিদ রাতুল এবং ছাত্রদল কর্মী তানজীম হোসেন, তানভীর রহমান ও শুভ্র আচার্য জড়িত ছিলেন। তবে, উল্লেখিত ঘটনায় শুধু মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয় অভিযুক্তদের।

এ ছাড়া গত রবিবার বিশ্ববিদ্যালয়ের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম হলের ১০০১ ও ১০০২ নম্বর কক্ষে র‌্যাগিংয়ের ঘটনা ঘটে। হল প্রশাসন ও নির্বাচিত ছাত্র প্রতিনিধিরা গিয়ে ভুক্তভোগীদের উদ্ধার করেন।

জাকসু ভিপি আব্দুর রশিদ জিতু বলেন, ‘আমরা অ্যান্টি র‌্যাগিং সেল গঠন করেছি। সর্বশেষ ঘটনার বিচার নিশ্চিতে আমরা প্রশাসনকে সহায়তা করেছি। র‌্যাগিংয়ের অভিযোগ প্রমাণিত হলে কেউ পার পাবে না।’ বিশ্ববিদ্যালয়ে র‌্যাগিংয়ের বিষয়ে জুলাইযোদ্ধা অধ্যাপক গোলাম রব্বানী বলেন, ‘৫৩তম ব্যাচ ক্যাম্পাসে র?্যাগিং পায়নি। তবুও কেন তারা এমন কাজ করল, তা আমার বোধগম্য নয়। এই প্রশাসনের কাছ থেকে ভালো কিছু আশা করি না। ছাত্র সংসদকে এ বিষয়ে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে।’ শিবিরের কেউ জড়িত ছিলেন কি নাÑ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এমনটা আমার জানা নেই। এমনটা হলেও দলীয় বিবেচনায় পার পাওয়া উচিত না।’ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক একেএম রাশিদুল আলম বলেন, ‘আমরা র‌্যাগিংয়ের বিষয়ে জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করছি। র‌্যাগিংয়ের ঘটনায় কোনো ছাড় নয়। সাংবাদিকদের সহায়তা অব্যাহত থাকবে বলে প্রত্যাশা করছি।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মোহাম্মদ কামরুল আহসান বলেন, ‘আমরা এ বিষয়ে তৎপর। আমরা চাই না এমন ঘটনা আর ঘটুক। অভিযোগ এলে কালক্ষেপণ ছাড়াই এসব ঘটনার আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’