মাধ্যমিক ও কলেজ শিক্ষা মাউশি ভেঙে হচ্ছে নতুন দুই অধিদপ্তর

নিজস্ব প্রতিবেদক
১৩ অক্টোবর ২০২৫, ০১:০৩
শেয়ার :
মাধ্যমিক ও কলেজ শিক্ষা মাউশি ভেঙে হচ্ছে নতুন দুই অধিদপ্তর

বাংলাদেশের শিক্ষা প্রশাসনে বড় ধরনের কাঠামোগত পরিবর্তনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এরই ধারাবাহিকতায় মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) ভেঙে দুটি পৃথক অধিদপ্তর গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে একটি হবে ‘মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর’; অপরটি ‘কলেজ শিক্ষা অধিদপ্তর’। প্রধান উপদেষ্টা ইতোমধ্যে এ প্রস্তাবে সম্মতি দিয়েছেন বলে নিশ্চিত করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মাউশি ভাঙার এ সিদ্ধান্ত শুধু কাঠামোগত পরিবর্তন নয়; এটি বাংলাদেশের শিক্ষা প্রশাসনের নতুন দিকনির্দেশনার সূচনা করতে পারে। পাশাপাশি তারা এও বলেছেন, নতুন দুটি অধিদপ্তর তৈরি হলেও জনবল কাঠামো, বাজেট ও প্রযুক্তি সক্ষমতা সমন্বিত না হলে প্রশাসনিক জটিলতা আরও বাড়তে পারে।

গতকাল রবিবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব সিফাত উদ্দিন স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশে বলা হয়Ñ ‘মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর হতে মাধ্যমিক শিক্ষাকে পৃথক করে মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর এবং কলেজ শিক্ষা অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠার বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা সদয় সম্মতি জ্ঞাপন করেছেন।’

কমিটি গঠন

পৃথক দুই অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পূর্ণাঙ্গ অর্গানোগ্রাম ও কার্যতালিকা প্রণয়নের জন্য ৮ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে মন্ত্রণালয়। কমিটিকে আগামী ৩০ দিনের মধ্যে দুটি অধিদপ্তরের পূর্ণাঙ্গ কাঠামো প্রস্তুত করে মন্ত্রণালয়ে জমা দিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে থাকবেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের যুগ্ম সচিব (সরকারি মাধ্যমিক অধিদপ্তর) এবং সদস্য সচিব হবেন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের উপসচিব বা সিনিয়র সহকারী সচিব (সরকারি মাধ্যমিক-১)। অন্য সদস্যরা হলেনÑ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের উপসচিব (সরকারি কলেজ-১), জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি (উপসচিব পদমর্যাদার নিচে নয়), অর্থ বিভাগের ব্যয় ব্যবস্থাপনা/বাস্তবায়ন অনুবিভাগের প্রতিনিধি (উপসচিব পদমর্যাদার নিচে নয়), মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের উপপরিচালক (মাধ্যমিক), মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের উপপরিচালক (সাধারণ প্রশাসন) এবং সহকারী পরিচালক (বাজেট)।

অফিস আদেশে বলা হয়েছে, কমিটি ‘রুলস অব বিজনেস, ১৯৯৬’ অনুসরণপূর্বক নবগঠিত অধিদপ্তরগুলোর কার্যতালিকা প্রণয়ন, সাংগঠনিক কাঠামো (অর্গানাইজেশনাল চার্ট) ও কর্মবণ্টন (ডিস্ট্রিবিউশন অব ফাংশনস) তৈরি করবে। পাশাপাশি প্রতিটি অধিদপ্তরের টিও অ্যান্ড ই (টেবিল অব অর্গানাইজেশন অ্যান্ড ইকুইপমেন্ট) নির্ধারণ করবে অর্থাৎ জনবল কাঠামো ও দায়িত্ব বিভাজনের পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা দেবে।

মাউশির ইতিহাস ও প্রেক্ষাপট

বাংলাদেশে শিক্ষা প্রশাসনের ইতিহাসে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। স্বাধীনতার পর শিক্ষা প্রশাসনের বিকেন্দ্রীকরণ এবং তদারকির লক্ষ্যে ১৯৮১ সালে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এর আগে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা কার্যক্রম তদারক করত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে শিক্ষা অধিদপ্তর নামে একটি যৌথ সংস্থা। কিন্তু শিক্ষার স্তরভেদে নীতিমালা, বাজেট, শিক্ষক নিয়োগ ও প্রতিষ্ঠান ব্যবস্থাপনায় জটিলতা বাড়তে থাকায় ‘মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা’কে এক ছাতার নিচে এনে মাউশি গঠন করা হয়। বর্তমানে মাউশি দেশের প্রায় ৩০ হাজার মাধ্যমিক বিদ্যালয়, কলেজ, মাদ্রাসা ও শিক্ষক প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক ও একাডেমিক তদারকি করে থাকে।

তবে মাউশির প্রশাসনিক ভার, ক্ষেত্র বিস্তৃতি ও নীতি বাস্তবায়নের ধীরগতি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে সমালোচনা চলছিল। শিক্ষা বিশেষজ্ঞদের মতে, একই অধিদপ্তরের অধীনে মাধ্যমিক ও কলেজ শিক্ষা পরিচালনা করায় কাজের ভারসাম্য ও জবাবদিহি দুটোই দুর্বল হয়ে পড়েছিল।

সংস্কারের সম্ভাব্য সুবিধা

পৃথক অধিদপ্তর গঠনের ফলে মাধ্যমিক ও কলেজ শিক্ষা পৃথক নীতিমালা ও প্রশাসনিক তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হবে। ফলে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন সম্ভব হবে। কর্মকর্তারা নির্দিষ্ট স্তরভিত্তিক কাজের ওপর মনোযোগ দিতে পারবেন। মাধ্যমিক ও কলেজ পর্যায়ে প্রকল্প বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা ও গতি বৃদ্ধি পাবে। মাধ্যমিক ও কলেজ শিক্ষায় ভিন্ন বাস্তবতা অনুযায়ী পরিকল্পনা প্রণয়ন করা যাবে। তবে নতুন দুটি অধিদপ্তর তৈরি হলেও জনবল কাঠামো, বাজেট ও প্রযুক্তি সক্ষমতা সমন্বিত না হলে প্রশাসনিক জটিলতা আরও বাড়তে পারে বলে সতর্ক করছেন বিশেষজ্ঞরা।

বাংলাদেশ শিক্ষা প্রশাসন সমিতির সাবেক সভাপতি অধ্যাপক হুমায়ুন কবির বলেন, দুটি নতুন অধিদপ্তর তৈরি ভালো উদ্যোগ। কিন্তু এটি যেন শুধু ‘বিভাগ ভাগ’ না হয়। প্রকৃত দক্ষতা-নির্ভর জনবল নিয়োগ ও প্রশাসনিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে না পারলে এটি কাগজে-কলমেই থেকে যাবে। তিনি বলেন, সরকারের এ উদ্যোগে শিক্ষা প্রশাসনে এক যুগান্তকারী পরিবর্তনের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। দীর্ঘদিনের একীভূত ব্যবস্থাকে ভেঙে আলাদা দুটি অধিদপ্তর গঠনের মাধ্যমে সরকার শিক্ষার দুই স্তরে নতুন কাঠামোগত ভারসাম্য আনতে চাইছে। তবে সফল বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন সুশৃঙ্খল জনবল, পর্যাপ্ত বাজেট ও তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর তদারকি ব্যবস্থা।