এলডিসি উত্তরণের আগেই ব্যয়বহুল বৈদেশিক ঋণ

আবু আলী
১৩ অক্টোবর ২০২৫, ০৭:১৯
শেয়ার :
এলডিসি উত্তরণের আগেই ব্যয়বহুল বৈদেশিক ঋণ

স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে দেশের ব্যবসায়ীদের। এ জন্য তাঁরা নির্ধারিত সময়সীমা পিছিয়ে দেওয়ারও দাবি তুলেছেন। ব্যবসায়ীদের দাবি, এই মুহূর্তে এলডিসি থেকে উত্তরণ হলে রপ্তানি খাতসহ নানা খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উত্তরণের (এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন) আগেই বাংলাদেশের নমনীয় বা সহজ শর্তের ঋণপ্রবাহ ক্রমাগত কমছে। এতে ব্যয়বহুল হয়ে পড়ছে বৈদেশিক ঋণ। এমন কী গত অর্থবছরে সরকারের মোট বৈদেশিক ঋণের প্রায় অর্ধেকই বাজারভিত্তিক হারে নেওয়া হয়েছে। এ জন্য স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উত্তরণের সময় পেছানোর দাবি করে বসে না থেকে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রস্তুতি নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তাঁরা। তা নাহলে একূল-ওকূল দুই কূলই হারাবে দেশ।

অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্য অনুযায়ী, সরকারের বাজারভিত্তিক সুদহারের ঋণে বড় আকারে উল্লম্ফন ঘটেছে। বর্তমানে এলডিসিভুক্ত থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ ২০২৪-২৫ অর্থবছরে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে যে ঋণ নিয়েছে, তার ৪২.৭ শতাংশই বেশি সুদের বাজারভিত্তিক ঋণ। এর আগের অর্থবছরে এ ধরনের ঋণের পরিমাণ

ছিল মাত্র ২৮.২ শতাংশ। জানা গেছে, আগামী অর্থবছরে বাজারভিত্তিক ঋণের হার আরও বাড়তে পারে এবং তা মোট বৈদেশিক ঋণের ৫০-৬০ শতাংশ পর্যন্ত গড়াতে পারে।

ইআরডির কর্মকর্তারা জানান, সিকিউরড ওভারনাইট ফাইন্যান্সিং রেটের (সোফর) সঙ্গে যুক্ত ঋণগুলো এখন অনেক বেশি ব্যয়বহুল হয়ে উঠেছে। বৈশ্বিক সুদের হার বৃদ্ধির কারণে এসব ঋণ আর আগের মতো স্বল্পসুদের গণ্য হচ্ছে না। বাজারভিত্তিক ঋণ যেগুলো ডলারে নেওয়া হয়েছে, সোফর রেট বেশি হওয়ায় এসব ঋণের নমনীয় হার আর নেই।

জানা গেছে, এলডিসি থেকে উত্তরণের পর সহজ শর্তের ঋণ বন্ধ হবে, এমনকি রুদ্ধ হবে অনুদান আসাও। ফলে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে দ্রুত প্রস্তুতি ও পদক্ষেপ নেওয়ার তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। কারণ, এলডিসি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর সেই চাপ সামাল দেওয়া আরও কঠিন হবে। তবে উত্তরণের পরও যেহেতু তিন বছর সময় পাওয়া যাবে, সে কারণে এখনই প্রস্তুতি নিতে হবে। এ জন্য এলডিসি উত্তরণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্থিতিশীল রাখা, বেসরকারি খাতের ঋণের সুদহার স্থিতিশীল রাখা এবং রপ্তানির বৈচিত্র্যকরণ জরুরি।

ব্যবসায়ীরা বলেছেন, এলডিসি থেকে উত্তরণের পর বাংলাদেশকে বেশ কিছু নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হবে। যেমনÑ বিশ্বব্যাংক, এডিবি এবং জাতিসংঘের তহবিলের মতো দাতাদের কাছ থেকে বাংলাদেশ ধীরে ধীরে নমনীয় ঋণ এবং অনুদানের সুবিধা হারাবে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কাছ থেকে সহজ শর্তে (কনসেশনাল) ঋণ প্রাপ্তির সুযোগও সীমিত হয়ে যেতে পারে। সুদের হার এবং পরিশোধের শর্তাবলী আরও কঠোর হবে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সাহায্য এবং অনুদান কমে যেতে পারে, যা দেশের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর অর্থায়নে প্রভাব ফেলতে পারে। বিশেষ করে মেধাস্বত্ব অধিকার (ট্রিপস) চুক্তি পরিপালন। ট্রিপস চুক্তির কঠোর বিধিমালা মেনে চলতে হবে, যা ওষুধ শিল্পের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হতে পারে।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন আমাদের সময়কে বলেন, এলডিসি উত্তরণ হলেও প্রকল্প ঋণের তেমন পরিবর্তন হবে না। বেশিরভাগ প্রকল্প ঋণের শর্ত বহাল থাকবে, কারণ বিশ্বব্যাংক ও এডিবির মতো বহুপাক্ষিক সংস্থা তাদের ঋণকে এলডিসি স্ট্যাটাসের সঙ্গে যুক্ত করে না। ফলে এলডিসি উত্তরণের প্রভাবে এতে খুব একটা হেরফের হবে না। কারণ বাংলাদেশ যে পরিমাণ বিদেশি সহায়তা পায়, তার খুব সামান্য অংশই এলডিসি মর্যাদার সঙ্গে যুক্ত। তাই এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন হলেও এ ধরনের ঋণ একেবারে বন্ধ হবে না। কারণ সদ্য উত্তীর্ণ দেশগুলো তিন থেকে পাঁচ বছর পর্যন্ত এই সুবিধা পেয়েছে। তিনি বলেন, আমাদের আগে থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে।

ইআরডির তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ ২০২৪-২৫ অর্থবছরে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ মোট ঋণ নিয়েছে ৭.৯৪২ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে ৩.৩৮ বিলিয়ন ডলারই বাজারভিত্তিক। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সরকারের মোট ঋণের ২৮.২ শতাংশ ছিল বাজারভিত্তিক ঋণ। এর আগের অর্থবছরে এই হার ছিল ২৫.৯ শতাংশ।

জানা গেছে, বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ও অর্থনৈতিক অন্যান্য সূচক বিবেচনায় নমনীয় ঋণের পরিমাণ ক্রমাগত কমে আসছে। এতে বাজারভিত্তিক ঋণে সরকারকে ৪-৫ শতাংশ বেশি সুদ দিতে হচ্ছে বলে পরিশোধের চাপও বাড়ছে।

ইআরডি সূত্র জানিয়েছে, সোফর সুদহারে নেওয়া ঋণগুলো এখন অনমনীয় ঋণ হিসেবে চিহ্নিত, কারণ অন্যান্য ফি যোগ করার পর এগুলোর সুদহার এখন ৬-৭ শতাংশ পর্যন্ত। উচ্চ সোফর রেটের কারণে ভাসমান সুদহারে সরকার যে উন্নয়ন ঋণ এবং বাজেট সহায়তা নিচ্ছে, তাও এখন এই শ্রেণিতে পড়ছে।