মারিয়া কোরিনা মাচাদো /
ঘনায়মান অন্ধকারে উজ্জ্বল জোনাকি
আঁধার ঘনিয়ে আসছে। স্বৈরশাসনের শীত জেঁকে বসছে। কিন্তু এরই বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের শিখা জে¦লে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি মারিয়া কোরিনা মাচাদো। ভেনেজুয়েলার বিরোধীদলীয় নেতা। তিনিই এবার শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেলেন। বুলেটের বিরুদ্ধে ব্যালটÑ এই নীতিতে জীবন উৎসর্গ করার স্বীকৃতি পেলেন তিনি। না, অনেক কথা বাজাবাজি ও তোড়জোড়ের পরও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই খ্যাতি অর্জন করতে পারলেন না। এমনকি গাজায় বহুল প্রতীক্ষিত যুদ্ধবিরতি এনে দিয়েও। তবে তাঁরই ‘গোপন মিত্র’ নোবেল পেলেন। কারণ, ভেনেজুয়েলায় ক্ষমতাসীন মাদুরো সরকারকে পতনে যুক্তরাষ্ট্রের ষড়যন্ত্র ও পদক্ষেপের কথা গণমাধ্যমে এরই মধ্যে উঠে এসেছে।
নরওয়ের নোবেল শান্তি কমিটি গতকাল পুরস্কার ঘোষণার সময় বলেছে, ভেনেজুয়েলায় ক্রমবর্ধমান স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের সংগ্রামকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য এবং জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় তাঁর নিরলস কাজের জন্য মাচাদোকে এই সম্মাননা দেওয়া হচ্ছে। এই পুরস্কার তাঁকে একজন সাহসী ও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ শান্তি যোদ্ধার স্বীকৃতি দেয়। তিনি ক্রমবর্ধমান অন্ধকারের মাঝেও গণতন্ত্রের শিখাটিকে জ্বলন্ত রেখেছেন। কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতার মতো মাচাদো যেন ‘ঘনায়মান অন্ধকারে একগুচ্ছ জোনাকিদের’ মধ্যে উজ্জ্বলতম জোনাকি।
নোবেল কমিটি এক বিবৃতিতে বলেছে, ৫৮ বছর বয়সী মারিয়া মাচাদো শুধু ভেনেজুয়েলার গণতন্ত্র আন্দোলনের নেতাই নন, তিনি সাম্প্রতিককালে লাতিন আমেরিকার নাগরিক সাহসিকতার এক অসাধারণ উদাহরণ। তিনি প্রকৌশল ও অর্থনীতিতে পড়াশোনা করেছেন। ১৯৯২ সালে তিনি কারাকাসের পথশিশুদের কল্যাণে আতেনিয়া ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন। এর ১০ বছর পর, তিনি সুমেতের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হন। এই সংস্থাটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনকে উৎসাহিত করে এবং নির্বাচন পর্যবেক্ষণ ও প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে।
আরও পড়ুন:
একে আবদুল মোমেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী
মাচাদোর রাজনৈতিক জীবন শুরু হয় ২০১০ সালে। তিনি সেবার রেকর্ডসংখ্যক ভোট পেয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তবে ২০১৪ সালে স্বৈরাচারী সরকার তাঁকে পদ থেকে বহিষ্কার করে। এরপরও তিনি সংগ্রাম চালিয়ে যান। তিনি ভেনতে ভেনেজুয়েলা নামের বিরোধী দলের নেতৃত্ব দেন এবং ২০১৭ সালে সোয় ভেনেজুয়েলা জোট প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করেন, যা রাজনৈতিক বিভাজন অতিক্রম করে গণতন্ত্রপন্থি শক্তিগুলোকে এক ছাতার নিচে আনেন।
নোবেল কমিটির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভেনেজুয়েলা একসময় তুলনামূলকভাবে গণতান্ত্রিক ও সমৃদ্ধ দেশ ছিল। কিন্তু তা এখন এক বর্বর, স্বৈরাচারী রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে, যেখানে ভয়াবহ মানবিক ও অর্থনৈতিক সংকট চলছে। দেশের অধিকাংশ মানুষ চরম দারিদ্র্যে বাস করে, অথচ মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ নিজেদের বিত্তশালী করে তুলছে। রাষ্ট্র নাগরিকদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। প্রায় ৮০ লাখ মানুষ দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। নির্বাচন কারচুপি, আইনি হয়রানি ও কারাবাসের মাধ্যমে বিরোধী পক্ষকে পদ্ধতিগতভাবে দমন করা হয়েছে।
২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে সামনে রেখে মারিয়া মাচাদো বিরোধী দলের প্রার্থী হিসেবে তাঁর নাম ঘোষণা করেন। কিন্তু সরকার তাঁর প্রার্থীপদ বাতিল করে দেয়। তখন তিনি বিরোধী দলের বিকল্প প্রার্থী এডমুন্ডো গঞ্জালেজ উরুতিয়াকে সমর্থন দেন। রাজনৈতিক মতভেদ ভুলে লাখ লাখ স্বেচ্ছাসেবক একত্র হয়ে নির্বাচন পর্যবেক্ষক হিসেবে প্রশিক্ষণ নেন একটি স্বচ্ছ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করার জন্য। হয়রানি, গ্রেপ্তার ও নির্যাতনের ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও নাগরিকরা ভোটকেন্দ্রগুলোতে নজরদারি করেন। তারা নিশ্চিত করেন, সরকার ব্যালট ধ্বংস বা ফলাফল নিয়ে মিথ্যা বলার আগেই যেন চূড়ান্ত গণনা নথিভুক্ত হয়। সম্মিলিত বিরোধী পক্ষের সাহসী, শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক প্রচেষ্টার ফলে সংগৃহীত তথ্যে স্পষ্ট দেখা যায়, বিরোধী দল বিপুল ব্যবধানে জয়লাভ করেছে। তবে স্বৈরাচারী সরকার নির্বাচনের ফল প্রত্যাখ্যান করে এবং ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে থাকে।
মারিয়া কোরিনা মাচাদোকে পুরস্কৃত করার মূল কারণ ভেনেজুয়েলায় গণতন্ত্রের অগ্রগতি হলেও বিশ্বজুড়েই গণতন্ত্র এখন পিছু হটছে। নিজের মতামত প্রকাশ করার, ভোট দেওয়ার ও নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমে প্রতিনিধিত্ব পাওয়ার অধিকার হলো গণতন্ত্র। দুর্ভাগ্যবশত, আমরা এমন এক বিশ্বে বাস করছি যেখানে স্বৈরাচারী সরকারগুলো নিয়মনীতিকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে এবং সহিংসতার আশ্রয় নিচ্ছে। ভেনেজুয়েলার মতো বিশ্বজুড়েই একই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে : ক্ষমতাসীনরা আইনের শাসনের অপব্যবহার করছে, স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে নীরব করা হচ্ছে এবং সমালোচকদের কারারুদ্ধ করা হচ্ছে।
আরও পড়ুন:
পাল্টে যেতে পারে আন্দোলনের ধরন
মারিয়া মাচাদো গুরুতর জীবননাশের হুমকি সত্ত্বেও দেশ ছাড়েননি, বরং আত্মগোপনে থেকেছেন। তাঁর এই সিদ্ধান্ত লাখ লাখ মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছে। মাচাদো দেখিয়েছেন, গণতন্ত্রের হাতিয়ারই হলো শান্তির হাতিয়ার। তিনি এমন এক ভবিষ্যতের আশা বহন করেন, যেখানে নাগরিকদের মৌলিক অধিকার সুরক্ষিত থাকবে ও তাদের কণ্ঠস্বর শোনা হবে। সেই ভবিষ্যতে, মানুষ অবশেষে শান্তিতে স্বাধীনভাবে জীবনযাপন করতে পারবে।