রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত শিক্ষা প্রশাসন গঠনের উদ্যোগ
আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে দেশের সব বেসরকারি স্কুল ও কলেজে গভর্নিং বডি (পরিচালনা পর্ষদ) নির্বাচন সম্পন্নের নির্দেশ দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত শিক্ষা প্রশাসন গঠনের লক্ষ্যে নতুন বিধিমালা অনুযায়ী এই নির্বাচন আয়োজনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, নির্বাচনের আগে পর্যন্ত বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যক্ষ বা প্রধান শিক্ষক নিয়োগ বন্ধ থাকবে। এ সময়ের মধ্যে নতুন নিয়োগব্যবস্থা কার্যকর করতে চায় সরকার, যেখানে নিয়োগ দেবে বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ)।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ সম্প্রতি জারি করা এক পরিপত্রে জানিয়েছে, ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে দেশের সব বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গভর্নিং বডি পুনর্গঠন করতে হবে। নতুন বিধিমালা অনুযায়ী, কোনো রাজনৈতিক দলের পদধারী ব্যক্তি, সাবেক জনপ্রতিনিধি বা দণ্ডপ্রাপ্ত কেউ পরিচালনা পরিষদের সদস্য হতে পারবেন না।
এ ছাড়া অভিভাবক প্রতিনিধি, প্রাক্তন শিক্ষক, স্থানীয় প্রশাসনের প্রতিনিধি এবং সমাজের বিশিষ্ট শিক্ষানুরাগীদের অগ্রাধিকার দিয়ে নির্বাচন আয়োজনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অ্যাডহক কমিটির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই নির্বাচন সম্পন্ন করতে বলা হয়েছে, যাতে প্রশাসনিক শূন্যতা না তৈরি হয়।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘সরকার চাইছে নির্বাচনের আগে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক স্থিতি ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে। দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে শিক্ষাব্যবস্থার প্রশাসনিক কাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এবার তা থেকে বেরিয়ে আসার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।’
শিক্ষাবিদদের মত : দীর্ঘদিন ধরে গভর্নিং বডিতে স্থানীয় রাজনীতিক ও জনপ্রতিনিধিদের প্রভাবের অভিযোগ রয়েছে। এতে শিক্ষক নিয়োগ, পদায়ন ও প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে দলীয় আনুগত্য প্রাধান্য পেয়েছে বলে শিক্ষাবিদরা মনে করেন। শিক্ষাবিদ ড. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ‘গভর্নিং বডিতে রাজনীতিকরা থাকলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রাজনৈতিক মঞ্চে পরিণত হয়। শিক্ষকরা পেশাগত স্বাধীনতা হারান, শিক্ষার্থীরাও প্রভাবমুক্ত থাকতে পারেন না। সরকার যদি সত্যিই নিরপেক্ষ কাঠামো বাস্তবায়ন করতে পারে, এটি হবে বড় সংস্কার।’
অধ্যক্ষ নিয়োগে এনটিআরসিএর ভূমিকা : আগে অধ্যক্ষ নিয়োগ দিত গভর্নিং বডি, যেখানে রাজনৈতিক প্রভাবের অভিযোগ ছিল ব্যাপক। নতুন পরিকল্পনা অনুযায়ী, এনটিআরসিএর মাধ্যমে যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হবে। মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘এনটিআরসিএর মাধ্যমে নিয়োগ হলে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্তভাবে যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ নিশ্চিত করা যাবে।’
তবে শিক্ষক সংগঠনগুলোর একাংশ আশঙ্কা প্রকাশ করেছে যে, এনটিআরসিএর হাতে সব ক্ষমতা গেলে তৃণমূলের প্রতিনিধিত্ব হারিয়ে যেতে পারে। বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. শাহজাহান আলম বলেন, ‘রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করা ভালো উদ্যোগ। কিন্তু বিদ্যমান আইনে তা করতে হলে শিক্ষা বোর্ড আইন সংশোধন প্রয়োজন।’
অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা : শিক্ষার্থীরা বলছেন, শিক্ষক বদলি বা নিয়োগে রাজনীতির প্রভাব পড়লে শিক্ষার মান নষ্ট হয়। ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমরা চাই শিক্ষকরা রাজনীতি নয়, পড়াশোনায় মনোযোগ দিন। নতুন নীতিমালা যদি তা নিশ্চিত করে, সেটাই হবে বড় সাফল্য।’
অভিভাবক রুবিনা ইসলাম বলেন, ‘স্কুল-কলেজে রাজনীতির প্রভাব কমলে শিক্ষায় নতুন আস্থা তৈরি হবে। সরকারকে অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে যেন প্রক্রিয়াটি স্বচ্ছভাবে বাস্তবায়িত হয়।’
আরও পড়ুন:
একে আবদুল মোমেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী
চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে : বিশ্লেষকদের মতে, সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে যোগ্য ও নিরপেক্ষ সদস্য নির্বাচন।
ড. মোজাম্মেল হক বলেন, ‘বাংলাদেশের সামাজিক বাস্তবতায় পুরোপুরি রাজনীতিমুক্ত মানুষ পাওয়া কঠিন। তাই স্বচ্ছ প্রক্রিয়া ও প্রশাসনিক মনিটরিং অত্যন্ত জরুরি।’
জাতীয় নির্বাচনের আগে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এই পদক্ষেপকে অনেকে শিক্ষা প্রশাসনে রাজনৈতিক সংস্কারের সূচনা হিসেবে দেখছেন। তবে বাস্তবায়নের সততা ও দৃঢ়তার ওপরই নির্ভর করবে উদ্যোগটির সফলতা।