অর্থপাচারের আঘাতে জর্জরিত অর্থনীতি
বাংলাদেশ আগের চেয়ে অনেক উন্নত হয়েছে। এর সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনীতি আজ অনেক বড় আকার ধারণ করেছে- জিডিপি দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫০০ বিলিয়ন ডলার। রপ্তানি আয় বছরে ৫০ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি, প্রবাসী আয়ও বছরে প্রায় ২২ বিলিয়ন ডলার।
এই উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ বিপুল অঙ্কের অর্থ অবৈধভাবে বিদেশে পাচার করার ব্যাপারেও বিশেষভাবে উন্নত হয়ে উঠেছে।
আন্তর্জাতিক বিভিন্ন রিপোর্টে যেমন গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি (GFI), বাংলাদেশ ব্যাংকের গবেষণা, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বা বিভিন্ন গণমাধ্যমের অনুসন্ধানে বারবার উঠে এসেছে যে, গত দশ বছরে (২০১৪-২০২৪) বাংলাদেশ থেকে অন্তত ৯০ থেকে ১০০ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে। এই অর্থের একটি বড় অংশ চলে গেছে কানাডা, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও দুবাইয়ের মতো দেশে, যেখানে বাংলাদেশের নাগরিকদের বিলাসবহুল ফ্ল্যাট, বাড়ি ও বিনিয়োগের তথ্য এখন আর গোপন নেই।
বাংলাদেশে থেকে অর্থপাচারের ধরন অনেক রকম। হুন্ডি এর মধ্যে সবচেয়ে পুরনো এবং প্রচলিত মাধ্যম। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বৈধ ব্যাংকিং চ্যানেল দিয়ে দেশে যে রেমিট্যান্স আসে, তার অন্তত ৩০-৩৫ শতাংশ সমপরিমাণ অর্থ আসে অনানুষ্ঠানিক হুন্ডির মাধ্যমে, যা দেশের অর্থনীতিতে রেকর্ড হয় না। যদিও আগে ধারণা করা তো যে, হুন্ডির মাধ্যমেই মূল অর্থ পাচার হয়ে থাকে কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন।
মুদ্রাপাচারের মূল মাধ্যম হলো বাণিজ্যভিত্তিক অর্থপাচার। ইনভয়েস জালিয়াতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা পাচার হচ্ছে। এক গবেষণা বলছে, বাংলাদেশে আমদানি-রপ্তানির প্রায় ১৮-২০ শতাংশ লেনদেনে আন্ডার ইনভয়েসিং ও ওভার ইনভয়েসিং ঘটে। উদাহরণস্বরূপ, একটি যন্ত্রপাতির প্রকৃত দাম যদি ১ লাখ ডলার হয়, ইনভয়েসে সেটি দেখানো হয় ৩ লাখ ডলার, ফলে অতিরিক্ত অর্থ বিদেশে থেকে যায়। আবার অনেক সময় পণ্য কম দামে দেখিয়ে বিদেশে জমা রাখা হয় বাড়তি অর্থ। এভাবে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর কয়েক বিলিয়ন ডলার পাচার হচ্ছে।
এই পদ্ধতির আরও উন্নত ধরন হলো দেশের ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে, সেই লোনের টাকা দিয়ে পণ্য উৎপাদন করে, সেই পণ্য বিদেশে রপ্তানি করে, রপ্তানি করা সেই অর্থ বা ডলার দেশে না আনা এবং দেশের ব্যাংকের লোনও পরিশোধ না করা। সম্প্রতি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, দেশের সুপ্রতিষ্ঠিত ১২০টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বিদেশে ১১২ কোটি ১০ লাখ ডলার পাচারের অভিযোগ পাওয়া গেছে। বাংলাদেশি মুদ্রায় যা ১৩ হাজার ৬৫৫ কোটি টাকারও বেশি। এই পদ্ধতিতে সিআইডির মতেই ক্রিসেন্ট লেদার প্রায় ২০৯৫ কোটি টাকা পাচার করেছে।
অর্থপাচারের আরেকটি বড় মাধ্যম হলো বিদেশে অবৈধ বিনিয়োগ। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত রিপোর্টে দেখা যায়, কানাডার টরন্টো শহরের বেগমপাড়া এখন বাংলাদেশি ধনী পরিবারের একটি আড্ডাখানা। ধারণা করা হয়, সেখানকার অর্ধশতাধিক বাড়ি বা ফ্ল্যাট বাংলাদেশি নাগরিকদের মালিকানায়। একইভাবে মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোম প্রোগ্রামের মাধ্যমে অনেকেই কোটি কোটি টাকা পাচার করেছেন। মালয়েশিয়ার অভ্যন্তরীণ মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, শুধু ২০০৬-২০১৬ সালের মধ্যে বাংলাদেশিরা প্রায় ৪০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি বিনিয়োগ করেছে সেখানে। দুবাইয়ের রিয়েল এস্টেট মার্কেটেও বাংলাদেশিদের বিনিয়োগের পরিমাণ ক্রমেই বেড়েছে।
অর্থপাচারের পেছনে প্রথম এবং প্রধান কারণ হলো দুর্নীতি। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের দুর্নীতি সূচকে বাংলাদেশ এক দশক ধরে নিম্ন অবস্থানেই রয়ে গেছে। দুদক (দুর্নীতি দমন কমিশন) স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে না, রাজনৈতিক প্রভাব এবং ক্ষমতাবানদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গেলেই বাধার সম্মুখীন হয়। ফলে অর্থপাচারকারীরা আইনের ফাঁক গলে বেঁচে যায়। দ্বিতীয় কারণ হলো দেশে বিনিয়োগ পরিবেশের দুর্বলতা। রাজনৈতিক অস্থিরতা, ব্যবসাবান্ধব পরিবেশের অভাব এবং দীর্ঘমেয়াদি নীতি অনিশ্চয়তার কারণে অনেক ধনী মানুষ মনে করে বিদেশে অর্থ রাখা নিরাপদ। তৃতীয় কারণ হিসেবে ধনী শ্রেণির বিদেশে স্থায়ী হওয়ার প্রবণতাও উল্লেখযোগ্য। তাদের সন্তানরা বিদেশে পড়াশোনা করে, পরিবার বিদেশে থাকে ফলে অর্থ সেখানে পাচার করাকে তারা স্বাভাবিক মনে করে।
এখন যদি আমরা গত দশ বছরের পরিসংখ্যান দেখি, তাহলে ছবিটা স্পষ্ট হয়। ২০১৪-২০১৬ সালে প্রতিবছর গড়ে ৬-৭ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। ২০১৭-২০১৯ সালে এ পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ৯-১০ বিলিয়ন ডলারে। ২০২০-২০২২ সালের কোভিড সময়কালে অর্থপাচার আরও বেড়ে যায়, কারণ বিদেশে স্বাস্থ্য নিরাপত্তা ও সম্পদ সুরক্ষার প্রবণতা তীব্র হয়। আর ২০২৩-২০২৪ সালে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকট তীব্র হওয়ার সময় পাচারের চাপ সবচেয়ে বেশি হয়। বিভিন্ন গবেষণা বলছে, এ সময়ে ১২-১৫ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত বিদেশে পাচার হয়েছে। এটি শুধু ডলার রিজার্ভকে ক্ষতিগ্রস্ত করেনি, বরং দেশের অর্থনীতি ও আর্থিক খাতে ভয়াবহ অস্থিরতা তৈরি করেছে।
অর্থপাচারের প্রভাব সাধারণ মানুষের জীবনে ভয়াবহ। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়ায় আমদানি ব্যয় মেটানো কঠিন হয়ে যায়, যার ফলে বাজারে ডলার সংকট তৈরি হয়। তাই আমদানিনির্ভর পণ্যের দাম বেড়ে যায়। যেহেতু আমাদের জ্বালানি তেল আমদানি করতে হয়- তাই বলা যায় ডলারের মূল্য বেড়ে গেলে আমাদের দেশের সব পণ্যের দাম বেড়ে যায়। টাকার মান ক্রমাগত কমতে থাকে, আর সাধারণ মানুষকে মূল্যস্ফীতির চাপে দিশাহারা হতে হয়। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, যদি এই পাচার হওয়া অর্থ দেশের ভেতরে বিনিয়োগ হতো, তাহলে বাংলাদেশের শিল্প, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অবকাঠামো খাতের চিত্র বদলে যেত। আমাদের দেশের চেহারা বদলে যেত। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে পাচারকৃত অর্থ বিদেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করছে আর বাংলাদেশকে করছে দুর্বল।
ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (BFIU) গঠন, ব্যাংকিং খাতে কেওয়াইসি (Know Your Customer) বাস্তবায়ন, অর্থপাচার রোধে নীতি প্রণয়ন ইত্যাদি কিছু জিনিস আমাদের দেশে আছে। কিন্তু বাস্তবে এগুলো অনেকটা কাগুজে ব্যবস্থার মধ্যে সীমাবদ্ধ। দুদককে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়া হয়নি। ব্যাংক ও কাস্টমসে এখনও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে লেনদেন ট্র্যাকিংয়ের ব্যবস্থা হয়নি। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যেসব দেশে অবৈধ সম্পদ রাখা হয়েছে, সেসব দেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি খুবই সীমিত। ফলে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনা প্রায় অসম্ভব।
আমার মতে, এই সংকট থেকে বের হতে হলে সবচেয়ে আগে দরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছা। দুর্নীতি দমন কমিশনকে স্বাধীন করতে হবে, ক্ষমতাবানদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নিতে হবে। ব্যাংক ও কাস্টমসে ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রতিটি লেনদেন নজরদারির আওতায় আনতে হবে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ইনভয়েস যাচাইয়ের জন্য বৈশ্বিক ডেটাবেসের সঙ্গে সমন্বয় জরুরি। পাশাপাশি যেসব দেশে বাংলাদেশিরা অবৈধভাবে সম্পদ রেখেছে, সেসব দেশের সঙ্গে শক্তিশালী কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালাতে হবে। আর সমাজে নৈতিক চাপ তৈরি করতে হবে, যাতে অর্থপাচারকারীরা সামাজিক মর্যাদা না পান।
আমি মনে করি, অর্থপাচার আজ বাংলাদেশের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় হুমকিগুলোর একটি। বিগত ১০ বছরে যে পরিমাণ অর্থ বিদেশে চলে গেছে, তার অর্ধেকও যদি দেশে থাকত, তাহলে বাংলাদেশ আজ অনেক শক্তিশালী অর্থনীতিতে পরিণত হতে পারত। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে প্রবৃদ্ধি ও বিনিয়োগ ধরে রাখতে হলে অর্থপাচার নিয়ন্ত্রণের বিকল্প নেই। এখন সময় এসেছে সরকার, গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজ একসঙ্গে এই বিষয়ে দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়ার। এই সরকারের কাছে আমার এ ব্যাপারে অনেক আশা ছিল। কিন্তু অল্প কিছু কাজ ছাড়া দৃশ্যত তেমন কার্যকরী কিছু পাওয়া যায়নি। ফেব্রুয়ারির পর যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক তাদের এই সমস?্যার সমাধান করতে হবে- অন্যথায় জিডিপির সংখ্যায় প্রবৃদ্ধি যতই বাড়ুক না কেন, দেশের অর্থনীতি ভেতরে ভেতরে ফাঁপা হয়ে পড়বে আর মানুষ দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হতে থাকবে।
রুবাইয়াত সাইমুম চৌধুরী : সহযোগী অধ্যাপক, ফিন্যান্স অ্যান্ড ফিনটেক, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি
মতামত লেখকের নিজস্ব