আলামত ‘গায়েব করে’ চার্জশিট দিল পুলিশ

হামিদ উল্লাহ, চট্টগ্রাম
০৮ অক্টোবর ২০২৫, ০৭:৩৬
শেয়ার :
আলামত ‘গায়েব করে’ চার্জশিট দিল পুলিশ

এক দশক আগে চট্টগ্রাম নগরীর কোতোয়ালি থানার রেয়াজউদ্দিন বাজারের আলোচিত বৈদেশিক মুদ্রা মামলার জব্দকৃত গুরুত্বপূর্ণ আলামত (প্রমাণ) গায়েব হয়ে গেছে। তদন্ত কর্মকর্তার গাফিলতি ও প্রতিবেদনে দেওয়া অসঙ্গতির কারণে এখন মামলাটি পরিণত হয়েছে পুলিশের দায়িত্বহীনতার এক দৃষ্টান্তে। এই ঘটনায় আদালত মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া বর্তমান কর্ণফুলী থানার ওসি মুহাম্মদ শরীফসহ ছয়জন সাবেক তদন্ত কর্মকর্তাকে আগামী ২২ অক্টোবর সশরীরে হাজির হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।

চট্টগ্রাম মহানগর বিশেষ ট্রাইব্যুনাল-৮-এর বিচারক সিরাজাম মুনীরা এই আদেশ দিয়েছেন। একই সঙ্গে আদালত চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ (সিএমপি) কমিশনার ও সহকারী কমিশনারের (প্রসিকিউশন) কাছেও আদেশের কপি পাঠিয়েছেন।

নিয়ম অনুযায়ী মামলাসংক্রান্ত জব্দ সব আলামত আদালতের মালখানায় থাকার কথা। কিন্তু তদন্ত কর্মকর্তারা সেখানে আলামত রাখেননি। আর অভিযোগপত্র দেওয়ার সময় পুলিশ পরিদর্শক মোহাম্মদ শরীফ বলেছেন, এসব আলামত তার কাছে নেই। আলামত ছাড়াই কীভাবে আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দিলেন?Ñ এমন প্রশ্নের জবাবে কিছু বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন মোহাম্মদ শরীফ।

আদালতে জমা দেওয়া অভিযোগপত্রে বলা হয়, মামলার আসামি জাফর আহমদ নগরীর রেয়াজউদ্দিন বাজার এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে অবৈধভাবে বিদেশি মুদ্রা ক্রয়-বিক্রয় করে আসছিলেন। তার কোনো বৈধ লাইসেন্স নেই। জাফর মূলত আচার ও সিগারেট বিক্রির আড়ালে অবৈধভাবে বিদেশি মুদ্রা ক্রয়-বিক্রয়সহ হুন্ডির মাধ্যমে দেশে-বিদেশে টাকা পাচারের ব্যবসা করে আসছিলেন।

মামলার প্রথম তদন্তকারী কর্মকর্তা, দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সাবেক সহকারী পরিচালক মানিক লাল দাশ আমাদের সময়কে বলেন, মামলাটি পুলিশের। একটি ধারার কারণে সেটি দুদককে তদন্তের জন্য দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু আমাকে দেওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে আইনের সেই ধারাটি পুলিশের তদন্তের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তখন আমি আদালতের নির্দেশে তদন্ত কার্যক্রম পুলিশের কাছেই হস্তান্তর করি।

আদালত সূত্র জানায়, ২০১৫ সালের ১২ নভেম্বর শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর এবং র‌্যাব-৭ কোতোয়ালি থানার বানিয়াটিলা স্টেশন রোডের বাসিন্দা জাফর আহমদের (৫৫) বাড়িতে অভিযান চালায়।

অভিযানে উদ্ধার করা হয় ওমান, মালয়েশিয়া, কাতার, থাইল্যান্ড, সৌদি আরব, ভারত, বাহরাইনসহ ১১টি দেশের বৈদেশিক মুদ্রা, বাংলাদেশি মুদ্রা, তিনটি পাসপোর্ট, ১১টি স্বর্ণবারের র‌্যাপার কভার, তিনটি ব্যাংকের চেকবই (ইস্টার্ন, পূবালী, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড) এবং পাঁচটি মোবাইল ফোন। সব মিলিয়ে দেশি ও বৈদেশিক মুদ্রার পরিমাণ প্রায় ২০ লাখ ১৬ হাজার ৮৪৪ টাকা সমমূল্যের। এর মধ্যে তদন্ত কর্মকর্তারা আলামতের তিনটি পাসপোর্ট, ১১টি স্বর্ণবারের র‌্যাপার কভার, তিনটি ব্যাংকের চেকবই (ইস্টার্ন, পূবালী, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড) এবং পাঁচটি মোবাইল ফোনের হদিস আদালতে দেননি। পরবর্তী সময়ে এসব মালামালের কিছু কাস্টম হাউসের কাস্টোডিয়ান শাখায় আর বাকি আলামত কোতোয়ালি থানায় জমা হয় বলে নথিতে উল্লেখ করা হয়।

ওই ঘটনায় শুল্ক গোয়েন্দা অধিদপ্তরের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা দীপংকর কুমার দত্ত বাদী হয়ে জাফর আহমদকে আসামি করে মামলা করেন।

মামলাটি প্রথমে তদন্ত করেন দুদকের তৎকালীন উপসহকারী পরিচালক মানিক লাল দাশ। এর পর পর্যায়ক্রমে দায়িত্ব পান কোতোয়ালি থানার এসআই আক্তার হোসেন, এসআই আনোয়ার হোসেন চৌধুরী, সিআইডির এসআই শুভ্র মুকুল চৌধুরী, সিআইডির ইন্সপেক্টর মো. মোয়াজ্জেম হোসেন এবং সর্বশেষ সিআইডির তৎকালীন পরিদর্শক ও বর্তমান কর্ণফুলী থানার ওসি মুহাম্মদ শরীফ। এই ছয় কর্মকর্তার প্রতিবেদনে আলামতের বিষয় নিয়ে দেখা যায় ভয়াবহ অসঙ্গতি ও পরস্পরবিরোধী তথ্য।

মানিক লাল দাশ বলেছেন, কিছু আলামত তার হেফাজতে ছিল, যা তিনি পরবর্তী তদন্ত কর্মকর্তার কাছে হস্তান্তর করেন। ওসি শরীফ অভিযোগপত্রে (চার্জশিট) লিখেছেন, মানিক লাল দাশ ২০১৫ সালের ৭ ডিসেম্বর আলামত নিজের হেফাজতে নেন। কিন্তু ২০২৫ সালের ৩ জুলাই আদালতে জমা দেওয়া প্রতিবেদনে তিনি আবার জানান, ২০১৮ সালের ৬ মার্চ সিআইডির এসআই শুভ্র মুকুল চৌধুরী এসব আলামত গ্রহণ করেন। একই কর্মকর্তা দুই ধরনের তথ্য দেওয়ায় আদালত তদন্তের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।

আদালত মন্তব্য করেন, অভিযোগপত্র দাখিলের আগে তদন্তকারী কর্মকর্তার দায়িত্ব ছিল পূর্ববর্তী কর্মকর্তাদের কাছ থেকে সব জব্দকৃত আলামত বুঝে নেওয়া এবং আদালত বা মালখানায় জমা দেওয়া। কিন্তু এ মামলায় তা অনুসরণ করা হয়নি। ওসি মুহাম্মদ শরীফ যথাযথ প্রক্রিয়া লঙ্ঘন করে অভিযোগপত্র দাখিল করেছেন, যা তদন্তের স্বচ্ছতা ও আইনি কাঠামোকে ব্যাহত করেছে।

এ অবস্থায় আদালত আগামী ২২ অক্টোবর ৬ কর্মকর্তাকে আলামতসহ হাজির হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।

আদালতের নথি অনুযায়ী, মামলার তদন্তে দায় এড়ানোর এক প্রবণতা স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। সংশ্লিষ্ট আদালতে এক কর্মকর্তা বলেছেন, আমি পাইনি, অন্যজন পেয়েছেন। অন্যজন বলেছেন, আমার দায়িত্বের আগেই আলামত নেওয়া হয়েছিল। ফলাফল কারও কাছেই আলামতের কোনো নথি বা রসিদ নেই। এভাবে তদন্ত কর্মকর্তা আলামত হারিয়ে ফেলা বা নষ্ট করার বিষয়টি পক্ষান্তরে মামলাকে আসামির অনুকূলে নিয়ে গেছে।

আর তখনই আসামিপক্ষ আদালতে দাবি করেছেন, জব্দকৃত মুদ্রা তার বৈধ সম্পদ, যা এখন ফেরতের জন্য তিনি আবেদন করেছেন। আসামির এই আবেদন মামলার নতুন মোড় নিয়েছে।

মামলার সর্বশেষ তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে ওসি মুহাম্মদ শরীফের ওপর ছিল মামলাটির সমাপ্তির দায়দায়িত্ব। অভ্যন্তরীণভাবে পুলিশ সদর দপ্তরের একাধিক সূত্র জানায়, তদন্তের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে আলামত সংরক্ষণে তিনি প্রয়োজনীয় সতর্কতা অবলম্বন করেননি, যা আদালতের নির্দেশে প্রকাশ্যে এসেছে।

পুলিশ সদর দপ্তরের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এই মামলাটি একটি দৃষ্টান্ত যেখানে একাধিক কর্মকর্তা দায়িত্বে থেকেও কেউ প্রকৃত দায়িত্ব পালন করেননি। এ ঘটনা পুলিশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন্ন করেছে।

আলামত সংরক্ষণ তদন্ত প্রক্রিয়ার অন্যতম মূল ভিত্তি। আলামত হারিয়ে গেলে মামলার রায় প্রভাবিত হয়। চট্টগ্রাম জজ কোর্টের আইনজীবী গোলাম মওলা সুজন বলেন, তদন্তের প্রতিটি ধাপে কর্মকর্তাদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা ও প্রমাণ রক্ষায় গাফিলতি দেখা গেছে। এটি ফৌজদারি তদন্ত প্রক্রিয়ার জন্য উদ্বেগজনক। যেখানে প্রমাণই হারিয়ে যায়, সেখানে ন্যায়বিচার কীভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে?Ñ এ প্রশ্ন এখন চট্টগ্রামের বিচারাঙ্গনে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে।